– ফাদার বাপ্পী এনরিকো ক্রুশ

যিশুর পথ আলোর পথ, যিশুর পথ ক্রুশের পথ অর্থাৎ ত্যাগের পথ। “তোমরা চোখ মেলে যিশুর দিকে তাকাও, তিনি তোমাদের আলোকিত করবেন”। বিশ্বাস কর, তিনি সব অন্ধকার, সব কালিমা ধুয়ে মুছে ফেলবেন। ক্রুশ কাষ্ঠের দিকে চেয়ে দেখ অনুতপ্ত সেই দস্যুর মতো তিনি তোমাকে টেনে নিবেন। তুমি পরিত্রাণ লাভ করবে এবং সেই অনুতপ্ত দস্যুর মতো অন্যকে আলোকিত করবে যিশুর দিকে ফিরে তাকাতে।

প্রায়শ্চিত্তকাল হলো পাপের জন্য অনুতাপ করা বা ত্যাগস্বীকার করা। আত্মার বিশুদ্ধতার সাধন করা। আত্মাকে ভালবাসি বলে আমরা আত্মা পরিষ্কার করতে চাই, পরিশুদ্ধ হতে চাই। তাই, প্রায়শ্চিত্ত মানে শুধু ত্যাগস্বীকার নয় বরং ভালবাসার মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধি হওয়া। একটা কাপড় পরিষ্কার করলে যেমন ময়লা চলে যায় আর আমরা পরিষ্কার কাপড় পড়তে পারি আর তা পড়ে আনন্দও করতে পারি। ঠিক তেমনি আমাদের আত্মা পরিষ্কার করতে হয় ভালবাসা ও ত্যাগস্বীকারের মধ্য দিয়ে। যাতে করে আমরা পবিত্র অন্তর নিয়ে আনন্দ করতে পারি। আমরা শুধু বাহ্যিক চেহারাতেই আমাদের পরিচয় তুলে ধরতে পারি না বরং অন্তর আত্মা পরিষ্কার পরিশুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে অন্যের কাছে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরতে পারি।

আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব যিশুকে অনুসরণ করা, তাঁকে প্রচার করা, তাঁর আলোতে সকলকে আলোকিত করা। তার অনুসরণের পথে যেকোন আত্মপ্রচার থেকে সর্তক থাকা এবং গোপনে তাঁর আধ্যাত্মিক পথে চলা কিন্তু তা মানুষকে আলোকিত করতে পারে যিশুর পথে চলতে। যদি মানুষকে সন্তুষ্ট করার বা তাদের প্রশংসা পাবার জন্য আমরা কোন ধর্মীয় বা বাহ্যিক কাজ করি, তাহলে তা অভিনেতাদের মতো অসারতার মঞ্চে ধর্মপরায়নতার ভান করি। যারা ঈশ্বরের কাজ করে না তারা শুধু নিজেকে খুঁজে বেড়ায়, নিজের আমিত্বকে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে চায়। যা কেবল লোক দেখানো কাজ হয়ে থাকে, সেই কাজে খ্রিস্টের কোন আলো বা প্রশংসা থাকে না। তখন আমরা কাঠ পোকার মত হয়ে উঠি। কাঠ পোকা কাঠের ভিতরের সব কিছু নষ্ট করে ফেলে, বাইরে থেকে কাঠের আসল রূপ কেউ দেখতে পায় না, মানুষের অজান্তেই তা শেষ হয়ে যায়। এই কাজের জন্য কোন পুরষ্কারও দেওয়া হয় না, কারণ তারা নিজেকে ছাড়া আর কিছু প্রকাশ করে না। তাহলে আমরা কি সেই কাঠ পোকার মত, ভিতরের সব কিছু নষ্ট করে দিচ্ছি আর বাইরে যিশুকে বাদ দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করছি। খ্রিস্টীয় আলো বাদ দিয়ে নিজেকে অন্যের কাছে আলোকিত করতে চেষ্টা করছি। দীক্ষাগুরু যোহন নিজেকে নয় অন্যদের মাঝে যিশুকে প্রকাশ করেছেন।

“বাতি জ্বেলে কেউ তা পাত্র দিয়ে ঢেকে রাখে না, বা খাটের তলায় রেখেও দেয় না; তা রেখে দেয় বাতিদানেই, যাতে বাড়ির ভেতরে যারা আসে, তারা যেন আলোটি দেখতে পায়।”  (লুক ৮:১৬ পদ)

পবিত্র বাইবেলে প্রভু যিশু খ্রিস্ট নিজেকে আলোর সাথে আখ্যায়িত বা তুলনা করেন। যোহন লিখিত মঙ্গলসমাচারে তিনি নিজের পরিচয় সুন্দর করে প্রকাশ করেছেন। আলোর সাথে তিনি নিজেকে তুলনা করেন। যিশুই হচ্ছেন আমাদের জীবনের আলো বা জ্যোতি। জীবন জ্যোতির অর্থ হলো; যে আলো বা জ্যোতি আমাদের জীবনের দিকে নিয়ে যায়। যারা পাপস্বীকার ক’রে পাপের ক্ষমা পেয়ে প্রভু যিশুকে নিজ জীবনে ত্রাণকর্তা এবং মুক্তিদাতা হিসেবে গ্রহণ করে, তাদের জীবনেই খ্রিস্ট জীবন জ্যোতি বা আলো হিসেবে প্রকাশিত হন।

খ্রিস্টই জ্যোতি
প্রভু যিশু খ্রিস্ট দাবী করেছেন তিনি জগতের জ্যোতি বা আলো। প্রকৃতপক্ষে তিনি আমাদের জীবনের জ্যোতি। প্রভু যিশু খ্রিস্টই নতুন নিয়মে জ্যোতির পূর্ণতা। শুধু তাই নয়, পুরাতন নিয়মেও সামসঙ্গীত রচয়িতা দায়ুদের গীত সংহিতায় ২৭:১ পদে বলেছেন’ “সদাপ্রভু আমার জ্যোতি আমার পরিত্রাণ”। যিশাইয়া ৬০:১ পদে লেখা আছে, “উঠ দীপ্তিমতি হও, কেননা তোমার দীপ্তি উপস্থিত”। যিহুদী রচয়িতাগণ এই পদ থেকেই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, মশীহের নাম হবে জ্যোতি। তাই দেখা যায় যে, যোহন লিখিত সুসমাচারে সেই জ্যোতির বিষয়ে যোহন সাক্ষ্য দিয়েছেন, যোহন ১:৭-৯ পদে “তিনি এলেন সাক্ষী দিতে সেই আলোরই বিষয়ে সাক্ষি দিতে, তাঁর কথা শুনে যাতে সবার অন্তরে বিশ্বাস জেগে উঠতে পারে। তিনি নিজেই সেই আলো ছিলেন না, কিন্তু সেই আলোর বিষয়ে সাক্ষি দিতেই এসেছিলেন। যিনি সেই সত্যিকার আলো, যে আলো প্রতিটি মানুষের অন্তর উদ্ভাসিত করে, তিনি তখন জগতে প্রবেশ করেছিলেন।” সত্যিকার অর্থে প্রভু যিশু খ্রিস্ট জীবন জ্যোতি। তিনি নিজেই আলো ছিলেন তাই অন্যকেও আলো দিতে পারতেন। ঈশ্বর তাঁকে সেই ক্ষমতা দিয়েছিলেন। প্রভু যিশুর এই জগতে আসার অন্যতম একটি কারণ ছিল পাপী মানুষকে পাপ থেকে উদ্ধার করে, তার জীবনে প্রকৃত আলো দিতে। আলো ছাড়া আমরা দেখতেও পারি না বা চলতেও পারি না। সাধারণত মানুষ আলো পছন্দ করে ও আলোতে বাস করতে চায়। অন্ধকার বা মন্দ কোন সুস্থ্য মানুষের কাম্য নয়। আলো এবং অন্ধকার পাশাপাশি চলতে পারে না। কারণ আলোর অস্তিত্ব আছে কিন্তু অন্ধকারের তো কোন অস্তিত্ব নেই। অন্ধকার হলো আলোর অনুপস্থিতি। আলো যেখানে নেই সেখানেই অন্ধকার আছে।

তাই জ্যোতি বা আলোর গুরুত্ব আছে। সূর্যালোক ছাড়া গাছ-পালা উদ্ভিদ খাদ্য তৈরী করতে পারে না, ফলে বৃদ্ধি পায় না, পুষ্প প্রস্ফুটিত হয় না, ফল পাকে না তেমনি সমস্ত ভাল কাজ আলোর সাথে সর্ম্পকিত। আলো এবং ভালো পাশাপাশি থাকে এবং চলে। তাই, যোহন ১:৪ পদে বলা হয়েছে, “তাঁর মধ্যে ছিল জীবন সেই জীবন ছিল মানুষের আলো”। প্রভু যিশু বলেছেন, “আমি জগতের আলো, যে আমার অনুসরণ করে সে কখনো অন্ধকারে চলবে না; সে-তো জীবনেরই আলো লাভ করবে”। আদম-হবার পাপের ফলে জগতে অন্ধকার নেমে এসেছিল, সেই অন্ধকার দূর করতে পিতা ঈশ্বর তাঁর একমাত্র পুত্র যিশু খ্রিস্টকে এই জগতে পাপী মানুষকে আলো বা জ্যোতি দেবার জন্য পাঠিয়ে ছিলেন। এফেসীয় ৫:৮ পদে লেখা আছে, “কারণ যদিও এক সময়ে তোমরা ছিলে যেন অন্ধকার, এখন কিন্তু প্রভুর সঙ্গে এক হয়ে তোমরা হয়ে উঠেছো আলো, তাই আলোর মানুষের মতই পথ চল তোমরা”। তেমনি আমাদের অবশ্যই আলোতে চলতে হবে। প্রভু যিশু খ্রিস্ট আমাদের জীবন জ্যোতি। তাই, আমাদের সেই জ্যোতিতে চলতে হবে। জ্যোতিতে চললে আমরা সর্বদা প্রভুকে সাথে নিয়ে জীবন-যাপন করতে পারব। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের জীবনেও যেন প্রভু যিশুর সেই জ্যোতি বা আলো থাকে। খ্রিস্টের জ্যোতি বা আলোতে আমাদের জীবন যেন আলোকিত হয় পিতা ঈশ্বর তাই চান।

খ্রিস্টের আলোয় সাক্ষ্যদান
আমরা দীক্ষাস্নানে খ্রিস্টের জ্যোতি বা আলো লাভ করেছি আর সেই আলোর সাক্ষী হবার যোগ্য হয়ে উঠেছি। আমরা যারা খ্রিস্টীয় পরিবারে জন্ম নিয়েছি তারা প্রত্যেকে নিজেদের খ্রিস্টান বলে দাবী করি। তবে আমরা কখনই নিজেকে খ্রিস্টান বলে পরিচয় দিতে পারি না। যতক্ষন না খ্রিস্টের স্বভাব অর্থাৎ খ্রিস্টীয় প্রেম, মনোভাব, নম্রতা, ভালবাসা আমার মধ্যে না থাকে। সাধু পল করিন্থীয়দের কাছে ১ম পত্রে ১:১০-১৭ পদে মধ্যে বলেছেন খ্রিস্ট মণ্ডলিতে আমাদের যেন কোন রকম দলাদলি না থাকে। আমরা যদি প্রকৃতভাবে খ্রিস্টের সাক্ষী হতে চাই বা খ্রিস্টের আলোর সাক্ষী হতে চাই তবে আমাদের কাজ-কর্ম, আচার-ব্যবহার, সৎ-জীবন, কথাবার্তা-ই জীবন্ত আলোর সাক্ষী হিসেবে ফুটে উঠবে। আমরা মুখে না বললেও আমাদের জীবনাচরণ দ্বারাই প্রকাশ পাবে যে, আমরা খ্রিস্টের সাক্ষী। তখনও (অর্থাৎ পলের সময়ও) মণ্ডলিতে দলাদলি, হিংসা, বিদ্বেষ ছিল- যা সাধু পলের এই পত্রে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। হতে পারে তখনকার পরিস্থিতি বা দলাদলির বিষয়টি ছিল এক রকম আর বর্তমান পরিস্থিতি বা দলাদলির বিষয়টি হচ্ছে ভিন্ন। দলাদলির ধরনটি পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু মূল বিষয়টি রয়েই গেছে।

আজও যদি মণ্ডলিতে এই অবস্থা বিদ্যমান থাকে তাহলে আমরা আলোর সাক্ষী হবো কিভাবে? আমরা যদি আলোর সাক্ষী হতে চাই বা বর্তমানে সেই একই আলোর সাক্ষী হতে চাই, তাহলে আমাদের তেমন ভাবেই হতে হবে যেমন মণ্ডলির শুরুতে ছিল। শিষ্যচরিতে লেখা আছে মণ্ডলির শুরুতে ছিল এরকম “তারা মিলে মিশেই জীবন-যাপন করতো। খ্রিস্টবিশ্বাসীরা তো ঐক্যবদ্ধ ছিল। দিনের পর দিন তারা একপ্রাণ হয়ে নিয়মিত ভাবেই মন্দিরে যেত এবং তাদের ঘরে রুটি-ছেঁড়ার অনুষ্ঠানও করত; তারা আন্তরিকভাবে আনন্দ ও সরলতার সঙ্গে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতো। নিত্যই ঈশ্বরের বন্দনা করতো তারা; সকলেই তাদের ভালবাসত। প্রভু পরিত্রাণের পথে যাদের নিয়ে আসছিলেন, তাঁরই প্রেরণায় তেমন সব মানুষ দিনের পর দিন এসে শিষ্যদলে যোগ দিচ্ছিল।” অর্থাৎ আদি মণ্ডলিতে পরস্পরের মধ্যে মিলন ও ভালোবাসার মনোভাব বিদ্যমান ছিল।

খ্রিস্ট কেন এই জগতে এসেছিলেন, আর কেনই-বা পাপী মানুষের জন্য নিজ প্রাণ ক্রুশে বিসর্জন দিয়েছিলেন? আমাদের প্রত্যেক খ্রিস্টবিশ্বাসীর এগুলো চিন্তার বিষয় এবং ধ্যানের বিষয়। যাই হোক, একজন যাজক বা ব্রতধারী হিসেবে এখন আমরা প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব কি? আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে খ্রিস্টের পক্ষে একজন উত্তম যোদ্ধা বা তাঁর সাক্ষী হওয়া। একজন উত্তম সাক্ষীর গুরুত্ব কতটুকু তা আমরা অতি সহজেই অনুধাবন করতে পারি যে, সাক্ষীদের কাজ হচ্ছে সত্য বিষয়টি সকলের সামনে তুলে ধরা।

খ্রিস্টের আলোয় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আমাদের জীবন আদর্শ কি হবে?
আমরা তো খ্রিস্টের সাক্ষী তাহলে আমাদের জীবনাদর্শে তা দেখাতে হবে। খ্রিস্টের পক্ষে সাক্ষী হবার জন্য উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন সাধ্বী মাদার তেরেজা। যিনি একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। এরপরেও নিঃস্ব অবস্থায় খালি হাতে মানুষের সেবা কাজের জন্য নিজেই পথে নেমে পড়েছিলেন। যিনি প্রতিনিয়ত যিশুর জন্য কাজ করেছেন এবং অনাথ-অবহেলিত, এতিম-অসহায়, রোগ-পীড়িত সবার পাশে দাঁড়িয়ে সেবাকাজ করছেন। আর এর মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন আর্দশ খ্রিস্টের শিষ্যা ও খ্রিস্টের সাক্ষী। সবার সামনে তিনি খ্রিস্টকে প্রকাশ ও প্রচার করেছেন। আর তাই তো তিনি বলতে পেরেছিলেন এই সব মানুষের মাঝে আমি স্বয়ং খ্রিস্টকে দেখতে পাই।

ঠিক তেমনিভাবে, যদি আমরা খ্রিস্টের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে চাই, তবে আমাকে বা আমাদেরকে কি করতে হবে? আমার জীবন দর্শন কি হবে? কবি রবিন্দ্রনাথের ভাষায় “সত্য সে তো বড়ই কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম”। কিন্তু কতজন পারে সত্যকে স্বীকার করতে? আমরা যদি খ্রিস্টের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে চাই, তবে কি সাক্ষ্য দিব? হ্যাঁ, আমরা বলতে পারি, প্রভু যিশু খ্রিস্ট আমাদের পাপের জন্য ক্রুশে প্রাণ দিয়েছেন ও আমাদের পরিত্রাণের জন্য পুনরুত্থিত হয়েছেন। এই সত্যে বিশ্বাসী হয়ে আমি যদি তাকে গ্রহণ করি ও আপন মুক্তিদাতারূপে যদি স্বীকার করি, তবেই আমি খ্রিস্টের সাক্ষি হতে পারব। যোহন ২০:৩১ পদে আছে, “তবে যা লিখে রাখা হলো, তা এজন্যেই লিখে রাখা হলো, যাতে তোমরা বিশ্বাস করতে পার যে, যিশু হলেন স্বয়ং খ্রিস্ট, স্বয়ং ঈশ্বর পুত্র এবং তা বিশ্বাস করেই তোমরা যেন তাঁরই নামের শক্তিতে জীবনও লাভ করতে পার।”

বর্তমানে অনেক ধর্ম নিরপেক্ষ লোকেরা যিশুকে একজন মহান ব্যক্তি বলে স্বীকার করেন। বর্তমানে মার্কসবাদীদের মধ্যেও ঈশ্বরের রাজ্যের প্রতি আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়। তারাও অতি উৎকৃষ্ট মানবতার অন্বেষণ করে থাকেন। মার্কসবাদীর চিন্তাবিদ রোজার গ্যারাডী বলেছিলেন, “মনে হচ্ছে ধর্ম লোকদের জন্য, আর আফিম নয়, কিন্তু তাড়ী বা খামিতে পরিণত হয়েছে।” কিন্তু যিশুকে অকপটে বিশ্বাস করার জন্য বা তাঁর সাক্ষী হবার জন্য এটাই কি খ্রিস্টানদের জন্য যথেষ্ট? যিশু কিন্তু এটা চিন্তা করেননি। যোহন তার সুসমাচারের প্রথম দিকে ২:২৪-২৫ পদে বলা হয়েছে এ ধরনের বিশ্বাসীদের সম্পর্কে বলেছিলেন, “কিন্তু যিশু নিজে তাদের ওপর কোন আস্থাই রাখতে না, কারণ সকলকেই তাঁর জানা ছিল। মানুষের বিষয়ে তাঁকে কেউ কিছু জানিয়ে দেবে, এমন প্রয়োজনও তাঁর ছিল না। মানুষের অন্তরের কথা তো তিনি নিজেই জানতেন”। যিশু আমাদের আরও অগ্রসর হওয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ করে বলেন, “তোমরা যদি আমার বাণী পালনে নিষ্ঠাবান থাক, তাহলেই তোমরা আমার যথার্থ শিষ্য, তাহলেই তো সত্যকে তোমরা জানতে পারবে, আর সত্য তখন তোমাদের স্বাধীন করে দেবে”(যোহন ৮: ৩১-৩২ পদ)।

খ্রিস্টের আলোয় সাক্ষী হবার ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা
আমাদের এই যাজকীয় বা ব্রতীয় জীবনটাই হচ্ছে বাণীপ্রচার ও খ্রিস্টের সাক্ষী হবার। আমাদের জীবন বাস্তবতায় যা করি, যা বলি, আর যা হয়ে উঠি সমস্ত কিছুই প্রকাশ করে খ্রিস্টের সাক্ষী। যেমন- বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, র্গীজা, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন যাজকীয় সেবাকাজ এসবই প্রকাশ করে আমাদের খ্রিস্টকে বা আলোর সাক্ষী হওয়া। আমরা কেউ এসব কিছু নিজের সুনাম, স্বার্থ ও প্রশংসার জন্য করছি না বরং তা করছি খ্রিস্টের জন্য এবং খ্রিস্টের প্রচার ও প্রকাশের জন্য তথা মণ্ডলির জন্য। সাধ্বী মাদার তেরেজা বলেছেন “আমি তাঁর হাতের পেন্সিল মাত্র তিনি যেভাবে চান সেইভাবে তিনি ব্যবহার করতে পারেন।” ঠিক আমরা যাজকরা সেরূপ পেন্সিলের মত কাজ করে যাচ্ছি। পেন্সিল যেমন নিজের ইচ্ছামত কাজ করতে পারে না, এটিকে যেভাবে চালানো হয় সে সেভাবেই চলে। পেন্সিল বা তুলি বা রং দ্বারা যখন কিছু লেখা বা আঁকা হয় তখন কিন্তু পেন্সিলের সুনাম বা প্রচার হয় না বরং যিনি তা করছেন তার নাম বা সুনাম চারিদিকে প্রচারিত হয়। মানুষ বা আমরা সেই অঙ্কন বা ছবি বা লেখা পছন্দ করে নিজেদের বলে গ্রহণ করে নেই। আমরা যাজকেরা ঠিক একই ভাবে খ্রিস্টের দ্বারা পরিচালিত হয়ে যাচ্ছি। তাই, আমাদের কাজ-কর্ম আমাদেরকে নয় বরং খ্রিস্টকেই প্রকাশ এবং প্রচার করছে। আমরা হয়ে উঠছি মাত্র তাঁর সাক্ষী। আর মানুষ তাঁকে নিজ জীবনে গ্রহণ করে তাদের চলার পথের আলো রূপে। আমরাও বিভিন্নজন বিভিন্ন ভাবে এবং বিভিন্ন দিকে কাজ করছি কিন্তু সকলের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে একই খ্রিস্টকে প্রচার করা ও তাঁর সাক্ষী হওয়া; যেমনটি বর্ণনা করা হয়েছে করিন্থীয়দের কাছে সাধু পলের ১ম পত্রে “কাজেই যে-লোক গাছ পুতে দেওয়ার কাজ করে, সেও কিছু নয়, আর যে-লোক জল দেওয়ার কাজ করে, সে-ও কিছু নয়; যিনি গাছটি বাড়িয়ে তোলেন, সেই স্বয়ং ঈশ্বরই সব কিছু” (১ম করিন্থীয় ৩:৫-১৭পদ)। মণ্ডলিতে ঠিক একই ভাবে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কেউ স্কুলে, কেউ সেমিনারীতে, কেউ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আর কেউ সরাসরি প্রৈরিতিক কাজ করছি। সব কিছুই করছি একই খ্রিস্টকে কেন্দ্র ও উদ্দেশ্য করে, তাঁরই হয়ে, তাঁরই নাম প্রচার করতে।

বাস্তব জীবনে আমরা খ্রিস্টের আলো
করিন্থীয়দের কাছে সাধু পলের দ্বিতীয় পত্রে উল্লেখ আছে “আমরা যে ঈশ্বরের সেবাকর্মী, তা সব ব্যাপারেই দেখাতে চেষ্টা করি। আমরা তো সব ব্যাপারেই যথেষ্ট ধৈর্য দেখিয়ে থাকি- স্বীকার করি যত ক্লেশ, দুর্গতি, সঙ্কট, যত প্রহার, কারাবাস, যত দাঙ্গা-হাঙ্গামা; স্বীকার করি বহু পরিশ্রম, রাত্রি-জাগরণ আর অনাহার। আমরা যে ঈশ্বরের সেবাকর্মী, তা আমরা দেখাই আমাদের শুচিতায় ও ধর্মজ্ঞানে, আমাদের সহিষ্ণু ও সহৃদয় ব্যবহারে, আমাদের অন্তরের পবিত্রতায় ও ভালবাসার অকপটতায়। আমরা প্রচার করি সত্যের বাণী। স্বয়ং ঈশ্বরের শক্তির ওপরই নির্ভরশীল আমরা” (২য় করি ৬: ৪-৬ পদ)। সাধু পল এখানে তার সেবা কর্মের কথা উল্লেখ করেন। যার মাধ্যমে তিনি খ্রিস্টের প্রকৃত সাক্ষ্য দান করেন। আমাদের বাস্তবতায়ও আমরা এ সকল বিষয়ের সম্মুখীন হই। যেমন-

– প্রতিটি যাজককেই সকাল থেকে মধ্য রাত্রী পর্যন্ত পরিশ্রম করতে হয়। সাধু পল যেমন বলেছেন রাত্রি জাগরণের কথা। আমরাও এভাবে খ্রিস্টের জন্য রাত্রি জাগরণ করে থাকি।
– যখন আমরা পালকীয় কাজের জন্য বিভিন্ন গ্রামে যাই বা অখ্রিস্টানদের মাঝে কাজ করতে যাই, লোকদের সাথে অবস্থান করি তখন অনেক সময় আমাদেরকে ত্যাগস্বীকার করতে হয়। হতে পারে দিনে একবার বা দু’বারও খেতে হয়। আবার অনেক সময় অখ্রিস্টানদের গ্রাম থেকে অনাহারে ফিরে আসতে হয়।
– আমরা যারা এই জীবনে রয়েছি প্রত্যেকেই খ্রিস্টভক্ত ও সাধারণ জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করে থাকি। তাদের জন্য এতকিছু করার পরেও তাদের স্বার্থের একটু আঘাত হলে প্রতিদানে আমাদের শুনতে হয় নানা কটুকথা, সইতে হয় অপমান-অপবাদ ও দুঃখযন্ত্রনা। যা প্রকাশ করে সাধু পলের ন্যায় খ্রিস্টের সাক্ষী হওয়া।
– আমাদের শুচিতা, কৌমার্য্য জীবনটাই অন্যের কাছে শুধু খ্রিস্টান নয় বরং অন্য ধর্মালম্বীদের কাছেও খ্রিস্টের সাক্ষীর জীবন্ত প্রকাশ। যে জীবন অন্য ধর্মালম্বীদের অনেকেই আঁকড়ে থাকে, ছাড়তে চায় না সেই জীবনকে আমরা স্ব-ইচ্ছায় বর্জন করি, খ্রিস্টের মহিমা ও সাক্ষী বহনের জন্য।

সমর্পিত জীবনে খ্রিস্টের জ্যোতির্ময় সাক্ষী
আমাদের প্রতিপালক সাধু জন মেরী ভিয়ান্নীর জীবনী সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। যিনি জ্ঞান-বুদ্ধির দিক দিয়ে নগণ্য ছিলেন কিন্তু আধ্যাত্মিকতায় ছিলেন মহান। এই ব্যক্তিকে যিশু কাজে লাগিয়েছেন এক মহৎ কাজে। সারাজীবন যিশুর জন্য কাজ করেছেন এবং এক বিশৃংখল ও পাপময় ধর্মপল্লীকে গড়ে তুলেছিলেন আর্দশ এক ধর্মপল্লীরূপে। মানুষের মনকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন ঈশ্বরের দিকে। নিজের জীবনে কষ্ট-ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং নানা কটুবাক্য সহ্য ও গ্রহণ করে সবাইকে আপন করে নিয়েছিলেন। তার একমাত্র কারণ তিনি খ্রিস্টের জন্য নিজের জীবন সপেঁ দিয়েছিলেন, খ্রিস্টের সাক্ষী হবার জন্য।

খ্রিস্টের সাক্ষী হতে হলে আমাদের প্রথম যা প্রয়োজন তা হচ্ছে খ্রিস্টেতে সমর্পিত জীবন। কারণ আজ আমরা অনেকেই নামধারী খ্রিস্টান। ১ তিমথী ২:৬-৭ পদে লেখা আছে, “যিনি সকলের মুক্তিপণ হিসেবে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এই ভাবে নির্ধারিত সময়ে তিনি ঈশ্বরের ত্রাণ সংকল্পের প্রত্যক্ষ প্রমাণও দিয়ে গেছেন। আমি সেই সত্যের ঘোষক ও দূতরূপে নিযুক্ত হয়েছি। আমি সত্যি কথাই বলছি, মিথ্যে কথা নয়, আমি নিযুক্ত হয়েছি খ্রিস্ট বিশ্বাস ও সত্যের শিক্ষায় বিজাতীয়দের দীক্ষিত করে তুলতে।” সুতরাং আমাদেরও খ্রিস্টের সাক্ষী হতে হলে বিশ্বাসে ও সত্যে অন্যদের শিক্ষক ও আলোর দিশারী হতে হবে। যাজক হিসেবে আমরা সবাই একই খ্রিস্টবিশ্বাসে বিশ্বাসী এবং সত্যের শিক্ষক। আমরা সকলে একটা সময় এই কথাটি স্বীকার ও গ্রহণ করেছি “এই বাণী তুমি গ্রহণ কর, যা তুমি গ্রহণ কর তা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস কর, যা তুমি বিশ্বাস কর তা প্রচার কর, যা তুমি প্রচার কর, তা নিজের জীবনে ধারন কর” কারণ খ্রিস্ট আমাদেরকে সত্য এবং স্বাধীনতা দান করেছেন। তিনি আমাদের শুধু তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে স্বাধীন করেছেন, আর আমরা শুধু তাঁর। আমরা আর কারও দাস নই। তিনি সত্য ও জীবন। তাই একমাত্র যিশুর সঙ্গে মিলে, তাঁর শিষ্য হয়ে আমরা সত্যকে গ্রহণ করতে পারি ও খ্রিস্টের একজন সত্যিকার সাক্ষি হতে পারি। শুধু খ্রিস্টীয় পরিবারে জন্ম নিয়ে বা নিজেকে খ্রিস্টান বলে পরিচয় দিয়েই আমরা খ্রিস্টের যথার্থ সাক্ষী হতে পারব না। নেইটজেক্সি যিশুর বিষয়ে বলেছিলেন, “একজন মাত্র খ্রিস্টান ছিলেন এবং তিনি ক্রুশে মারা গিয়েছিলেন”। মাহাত্ম গান্ধী যিনি অনেকবার সু-সমাচার পাঠ করেছিলেন তিনি একজন খ্রিস্টানকে বলেছিলেন, “যিশু আমাদের সকলের” কিন্তু যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, “আপনি কি তাঁর”? তিনি তখন নিরুত্তর রইলেন। এখানে আমরা দেখতে পাই তাঁর জীবনের উপর যিশুর একচেটিয়া দাবী ছিল বিঘœজনক।

খ্রিস্টের আদেশ তাঁর আলোকময় সাক্ষী হওয়ার জন্য এনেছে সুযোগ
সাধু পোপ ২য় জন পল খ্রিস্টের বিষয়ে এক অবিস্মরণীয় সাক্ষ্য দান করেছেন ক্ষমা ও ভালবাসা দেখানোর মধ্য দিয়ে। যে আলী আসকার তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল তাকে তিনি ক্ষমা দান করে বিশ্বের মানুষের কাছে খ্রিস্টীয় এক আর্দশ তুলে ধরেছেন। শত্রুকে বন্ধু করে ভালবেসে কারাগারে দেখতে গিয়েছেন। হয়তো এটাই ছিল তাঁর কাছে একটা বিরাট সুযোগ খ্রিস্টের সাক্ষী হবার এবং খ্রিস্টের আর্দশকে সবার সামনে তুলে ধরার। আমাদের জীবনেও অনেক সুযোগ আসে যার মধ্য দিয়ে খ্রিস্টকে অন্যের সামনে প্রকাশ করতে পারি।

খ্রিস্ট এ জগতে এসেছিলেন আমাদের পরিত্রাণ করার জন্যে। খ্রিস্টের মহান আদেশ খ্রিস্ট বিশ্বাসীদের বিরাট সুযোগ এনে দেয়। খ্রিস্ট আমাদের নতুন জীবন সেই পরিচর্যার জন্য নিবেদিত। মথি ৯:৩৮ পদে লেখা আছে, “তাই ফসলের মালিককে মিনতি জানাও, তিনি যেন তাঁর শস্যক্ষেতে কাজ করার লোক পাঠিয়ে দেন”। খ্রিস্টের নিজ জীবনের আদর্শ দ্বারা আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, প্রার্থনা আমাদের জীবনের প্রাথমিক ও প্রধান কাজ। খ্রিস্টের জীবন ও সাক্ষ্যে প্রার্থনা অপরিহার্য অংশ। গেৎসিমানী বাগানে যিশু প্রার্থনা ও শিষ্যদের সতর্ক করার মধ্যে তা নিহিত। তাঁর ঘাম রক্তরূপে ঝরেছে, তার মধ্যেও তিনি শিষ্যদের বলেছিলেন, “তোমরা জেগে থাক ও প্রার্থনা কর যেন পরীক্ষায় না পড়”। যিশুর পক্ষে একজন খ্রিস্টান বা যাজক হিসেবে সাক্ষ্য দিতে গেলে অবশ্যই আমাদের প্রার্থনাশীল মানুষ হিসাবে জীবন-যাপন করতে হবে। যিশু নিজ রক্তে আমাদের পাপ থেকে মুক্ত করেছেন এ কথা স্বীকার করতে হবে। যোহন ১:৭ পদে বলা হয়েছে, “তিনি এলেন সাক্ষী দিতে, তাঁর কথা শুনে যাতে সবার অন্তরে বিশ্বাস জেগে উঠতে পারে।” এই সত্যে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। সর্বোপরি ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তারে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে, তবেই আমরা তার উত্তম সাক্ষী হতে পারব। পরিশেষে বলতে চাই যে, ঈশ্বর আমাদের ভীরুতার আত্মা দেননি কিন্তু শক্তির, প্রেমের ও সু-বুদ্ধির আত্মাকে দিয়েছেন। সুতরাং, প্রভুর সাক্ষ্যের বিষয়ে আমরা যেন ভীত ও লজ্জিত না হই। বরং আরও উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে প্রভুর সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে চলি। ঈশ্বর আমাদের সকলকে তাঁর পবিত্র আত্মার শক্তি দান করুণ ও আর্শিবাদ করুন।

 

Please follow and like us: