ভূমিকা : গুড শেফার্ড ক্যাথেড্রাল থেকে মোট ৩টি গ্রাম আলাদা করে সাধু পিতর ধর্মপল্লী তৈরি করা হয়েছে। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ৩র জানুয়ারিতে, সাবেক মুশরইল টেকনিক্যাল স্কুল ভবনকে ‘সাধু পিতরের কোয়াজি ধর্মপল্লী ও সেমিনারি’ হিসেবে ঘোষনা দেন বিশপ জের্ভাস রোজারিও। খ্রিস্টভক্তদের নিবিড়ভাবে পালকীয় পরিচর্চা ও সন্তানদের সেবাদানের উদ্দেশ্যে ধর্মপল্লী প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই কোয়াজি ধর্মপল্লীর অধীনে রয়েছে ৩টি গ্রাম, সাধু ফ্রান্সিস আসিসির নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং লুইজিনা সিস্টারদের একটি কনভেন্ট। সেই সঙ্গে একই চত্বরে রয়েছে সাধু পিতর সেমিনারি।

ইতিহাস : মুশরইল ধর্মপল্লীর সর্বপ্রথম কাজ শুরু করেন ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীর প্রাক্তন পালক পুরোহিত ফা: পল চেচিরী, পিমে। শুরুতেই বড় বনগ্রাম মুশরইল চকপাড়ায় ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে, কাটেখিষ্ট হিসেবে নিয়োগ পান প্রয়াত- মিঃ লুকাশ সাউড়িয়া। বিশ্বাসের এ যাত্রাকে আরও জোরদার করতে রহনপুরের মিঃ যোসেফ মুর্মুকে কাটেখিষ্ট হিসেবে এখানে আনা হয়। তাকে প্রার্থনায় সহায়তা করেন মিঃ লাজারুশ হাঁসদা ও মিঃ জম্মু বিশ্বাস। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে মুশরইলে প্রথম দীক্ষা দেওয়া হয়।

সন্তোষপুর : প্রয়াত ফা: চেচ্কাতো পিমে, এই গ্রামে অবহেলিত দরিদ্র মানুষের জন্য জমি ক্রয় ক’রে তাদের দেশাশুনা ও শিক্ষার দায়িত্ব দেন হিলারিুশ বিশ্বাসকে (ভুগরুল)। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে এখানে ফা: পাওলো চিচিরী জনগণকে প্রথম দীক্ষা দেন। এখানে পরিবারের সংখ্যা ১৬৪টি।

মিরকামারী : আম্রকাননের এই গ্রামটি খুব দৃষ্টিনন্দন। এখানে বর্তমানে বসবাসরত পাহাড়ী জনগোষ্ঠী এক সময় তাদের কোন জায়গা না থাকায় সবাই ইমাতপুর নামক জায়গায় এক মুসলিমের জমিতে বসবাস করতো। ফা: পাওলো চিচিরী পিমে, এখানে পাহাড়ীদের জন্য বসতী গড়ে তোলেন এবং ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে দীক্ষা দেন। বর্তমানে এখানে রয়েছে মোট ১৮টি পরিবার।

মুশরইল টেকনিক্যাল স্কুল : স্থানীয় তথা রাজশাহী অঞ্চলের ছিন্নমূল এবং আদিবাসীদের কর্মক্ষম ও কর্মসংস্থানের জন্য ‘নভারা টেকনিক্যাল’- ২০১১ খ্রিস্টাব্দে পিমে ব্রাদারদের পরিচালনায় মুশরইল গ্রামে টেকনিক্যাল স্কুল শুরু করা হয়। কিন্তু যথেষ্ট শিক্ষার্থী না হওয়ায় তারা রাজশাহী ডাইয়োসিসের নিকট পুরো টেকনিক্যাল চত্বর হস্তান্তার করেন। এখানে রয়েছে ১৪৬টি পরিবার। উল্লেখ্য, সাধু পিতর ধর্মপল্লীর অধীনে মোট ৩টি গ্রামে বর্তমানে খ্রিস্টভক্তের সংখ্যা ১২৪০জনের মতো।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও আর্শীবাদ : গত ১৭ তারিখ সকাল সাড়ে ন’টায় উদ্বোধন ও আর্শীবাদ অনুষ্ঠান শুরু হয়। রাজশাহী ক্যাথলিক ডাইয়োসিসের বিশপ জের্ভাস রোজারিও মুশরইল গ্রামে এসে পৌঁছালে তাকে আদিবাসী নৃত্যের মাধ্যমে বরণ করে নেওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রধান অতিথি ও মাননীয় এডভোকেট ঝর্ণা গ্লোরিয়া সরকার, সংসদ সদস্য, সদস্য কেন্দ্রীয় কমিটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সদস্য আইন বিচার সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি ও সদস্য বেসরকারী সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত কমিটি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, ভিকার জেনারেল ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও ও সাধু পিতর ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত উইলিয়াম মুরমু। অতিথিগণ চার্চ প্রাঙ্গনে এসে পৌঁছালে তাঁদেরকে আদিবাসী কৃষ্টিতে হাত ধূয়ে বরণ করা হয়। এরপর বিশপ রোজারিও কোয়েজাই ধর্মপল্লীকে পূর্ণাঙ্গ ধর্মপল্লী হিসেবে ঘোষণা দেন এবং পরে ফিতা কেটে গির্জা ভবন উদ্বোধন করেন। পরে পাল পুরোহিত ফাদার মুরমু ভক্তগণকে গির্জা ঘরে প্রবেশের জন্য আহ্বান জানান। এই সময় ”আজি শুভদিনে পিতার ভবনে অমৃত সদনে চলো যাই” সংগীত ও নৃত্যের তালে তালে অতিথিবৃন্দ ও জনগণ গৃহে প্রবেশ করেন। এর পর শুধু হয় রোমান ক্যাথলিক বিধানমতে নতুন গির্জা ভবন আশীর্বাদ অনুষ্ঠান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রীতিগুলো ছিল- জল আর্শীবাদ ও সিঞ্চন, বাণী অনুষ্ঠান, সাধু-সাধ্বীদের প্রতি স্তব কীর্তন, বেদীতে সাক্ষ্যমরদের স্মৃতিচিহ্ন বা রেলিক স্থাপন, গির্জা প্রতিষ্ঠার মন্ত্র উচ্চারণ, পবিত্র তেল মেখে যজ্ঞবেদী অভিলেপন, গির্জায় স্থাপিত ক্রুশ আর্শীবাদ, নতুন প্রসাদ-মঞ্জুষা আর্শীবাদ, বেদী ও পুরো গির্জায় ধূপারতি প্রদান, বেদী সাজানো, বেদীতে আলো প্রজ্জ্বলন ইত্যাদি। একই সময়ে নতুন যাজক ভবনটিও আর্শীবাদ করা হয়। অনুষ্ঠান রীতির পরে বিশপ ৩৬ জন ছেলে-মেয়েকে হস্তার্পণ সাক্রামেন্ত প্রদান করেন।

খ্রিস্টযাগ শেষে অতিথি ও জনগণ- মূল ভবনের দু’তলায় নির্মিত হলরুমে প্রবেশ করেন। হলরুম উদ্বোধন করেন সংসদ সদস্য ঝর্ণা গ্লোরিয়া সরকার। এই সময় “সবারে করি আহ্বান” গান ও নাচের মধ্যদিয়ে ধর্মপল্লীর ছেলে-মেয়েরা ফুল দিয়ে অতিথিদের স্বাগত জানান। প্রধান অতিথি সংসদ সদস্য সরকার তাঁর বক্তব্যে গির্জাটি ঈশ্বরের মহাদান হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “ঈশ্বর যে তাঁর সন্তানদের ভালোবাসেন তার বড় প্রমাণ হলো এই গির্জা এবং হলরুম। আবার এগুলোর মধ্যদিয়ে যেন প্রমাণিত হয় ঈশ্বরের প্রতি ভক্তের ভালোবাসা।” এতো সুন্দর ভবন উপহার দেওয়ার জন্য তিনি বিশপকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সবশেষে বিশপ রোজারিও বলেন, “ঈশ্বর যে আমাদের সঙ্গে আছেন তার প্রমাণ এই ভবনগুলো। বাইরের কোন সাহায্য ছাড়া নিজেদের অর্থায়নে এগুলো নির্মাণ করা হয়েছে।” তিনি বলেন, সদ্ইচ্ছা থাকলে মানুষ সবই করতে পারেন। তিনি আরো বলেন, “এই ভবন নির্মাণ তখনই সার্থক হবে, যখন জনগণ এখানে সরল মন নিয়ে একসঙ্গে যাত্রা, মিলনধর্মী এবং নিজেদের কর্মপ্রেরণের মধ্যদিয়ে ঈশ্বরকে ডাকবে।” বিশপ রোজারিও ঈশ্বরকে সব দানের জন্য ধন্যবাদ দেন। সেই সঙ্গে প্রধান অতিথিকে এই অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি সার্বিক সহযোগিতার জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানান।

ভিকার জেনারেল ফাদার ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন- ঈশ্বরের দয়ায় এবং মানুষের সহায়তায় মুশরইলের গির্জা, হলরুম এবং ফাদারদের বাড়ী করতে পেরেছি। পবিত্র বাইবেলে আছে যিশু বলেছেন-মন্দির হল পিতার গৃহ পবিত্র স্থান। আমরা আসি ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হতে এবং পরস্পরের সাথে মিলিত হতে। মন্দির বা গির্জা হল একটা মিলনের গৃহ খ্রিস্টবিশ্বাসীদের জন্যে। এখানে আমরা যারা আসি তারা এক মন এক প্রাণ হয়ে উঠি। কারণ একই খ্রিস্টকে এই খ্রিস্টপ্রসাদে আমরা গ্রহণ করি। একই খ্রিস্ট আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে আসে এবং সেই খ্রিস্টে আমরা সকলে এক হয়ে উঠি। সেটাই হল আমাদের মিলন, একাত্মতা এবং সেটাই হল আমাদের ঐক্য। এই গির্জা ঘর হল আমাদের সেই খ্রিস্ট ঐক্যের প্রতীক এবং আমাদের খ্রিস্টধর্মের উপস্থিতির প্রতীক।

পাল-পুরোহিত ফাদার উইলিয়াম মুরমু তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন- আমরা এখানে সমবেত হয়েছি নতুন একটা যাত্রা ইতিহাস শুরু করতে। আমাদের মুশরইল গ্রাম ছিল কিন্তু আজ তা ধর্মপল্লীতে পরিণত হয়েছে। আর এ জন্য আমরা সমবেত হয়েছি ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে। ঈশ্বর যে আমাদেরকে ভালবাসেন তার প্রকাশ হচ্ছে বিশপ মহোদয়ের গির্জা নির্মাণের মধ্যদিয়ে আমরা লাভ করেছি ঈশ্বরের অসীম অনুগ্রহ। এই গির্জা আমাদের ঐশ আশীর্বাদের চিহ্ন হয়ে তার ভালবাসার প্রকাশ প্রতিনিয়ত আমাদের মাঝে ঘটিয়ে যাবেন।

খ্রিস্টযাগের পরে মিলনভোজের মধ্যদিয়ে এই আনন্দঘন দিনের সমাপ্তি ঘটে।

ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিবেদক

 

Please follow and like us: