গত ২৫-২৮ জুলাই, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারী বনানীতে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ধর্মপ্রদেশীয় যাজক ভ্রাতৃসংঘের বার্ষিক সেমিনার ও মিলনমেলা। বৈশ্বিক করোনা মহামারীর প্রাদূর্ভাব কাটিয়ে বিগত ২টি বছর শেষে আবারও বাংলাদেশ ধর্মপ্রদেশীয় যাজক ভ্রাতৃসংঘের যাজকগণ মিলিত হয়েছিল এক কাতারে। এ যেন এক আশির্বাদপুষ্ট সময়। ভাই পুরোহিতের সাথে ভাই পুরোহিতের মিলন। বিগত জীবনের সুখ-দুঃখ সহভাগিতার অবকাশ। এ আবেগ-অনুভূতি, সফলতা-ব্যর্থতা, হতাশা, একাকিত্ব, মানসিক যন্ত্রণা এই সকলই ভাগাভাগির এক বিশেষ মুহুূর্ত। তাই, একে অপরের সান্নিধ্যে এসে লাভ করে প্রেরণা, উৎসাহ, উদ্দীপনা, শক্তি ও নতুন করে পথ চলা। এমনটি বলছিলেন বিডিপিএফ-এর সভাপতি ফাদার জয়ন্ত গমেজ।
২৬ জুলাই সকালে পবিত্র খ্রিস্টযাগের মধ্যদিয়ে এই সম্মেলন বা এজিএমের যাত্রা শুরু হয়। পবিত্র খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও। এই সহার্পিত খ্রিস্টযাগে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের আর্চবিশপ বিজয় ডি’ক্রুশ ও খুলনা ধর্মপ্রদেশের বিশপ জেমস্ রমেন বৈরাগীসহ মোট ১৫৯ জন ধর্মপ্রদেশীয় যাজক।
খ্রিস্টযাগের উপদেশে বিশপ জের্ভাস রোজারিও শ্রবণের উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন- আমাদেরকে হতে হবে সিনোডাল মণ্ডলি। আর এই সিনোডাল মণ্ডলি গঠনের উদ্দেশ্যে এবারের এজিএমের মূল বিষয় রাখা হয়েছে ‘মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ।’ এই সিনোডাল চার্চ বা মণ্ডলি গঠনে আমাদেরকে দেহ-মন-আত্মার কান দিয়ে শুনতে হবে। অর্থাৎ, আমরা যেন ভালমতো শ্রবণ করি এবং হয়ে উঠি শ্রবণের মানুষ। কেননা, ঈশ্বর আমাদের শুনেন। তাঁরই প্রেরণকর্মী হিসেবে আমরা আমাদের ভাই-বোনদের কথা হৃদয় দিয়ে শুনব। সেই সাথে আমাদের প্রত্যেক যাজককে হয়ে উঠতে হবে জনগণের জন্য স্বর্গরাজ্য লাভের শিকারীর মতো।
সকাল ৮:৩০ মিনিটে পবিত্র বাইবেল পাঠ, প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে যাজকবর্গের বার্ষিক সেমিনার ও এজিএমের শুভ উদ্বোধন করেন আর্চবিশপ বিজয় ডি’ক্রুশ, ওএমআই। সেই সঙ্গে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ২০২১ ও ২০২২ খ্রিস্টবর্ষের যাজকীয় জীবনের রজত জয়ন্তী পালনকারী যাজক ভাইদেরকে শুভেচ্ছা, অভিনন্দন এবং প্রীতি উপহার প্রদান করা হয়। একই সাথে ২০১৯-২০২১ খ্রিস্টাব্দে যারা যাজকপদে অভিষিক্ত হয়েছেন সেই সমস্ত যাজকগণকে যাজকবর্গের সভায় শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানানো হয় এবং একইসাথে ভ্রাতৃসংঘের সংবিধান ও স্টোল তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ফাদার প্রশান্ত থিউটনিয়াস রিবেরু মূল প্রতিপাদ্য বিষয় “মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ”-র উপরে উপস্থাপনা প্রদান করেন। তিনি বলেন- আমরা যা বলি তা শুনি কিনা? এবং যা শুনি তা পালন করি কিনা! কেননা, আমরা না শুনলে মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণকাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারব না। তাই, আমাদের একসাথে পথ চলতে হলে মিলন সমাজ গড়তে হবে, অংশগ্রহণকারী মণ্ডলি হতে হবে এবং প্রেরণকাজে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
যাজক ভ্রাতৃসংঘ: ২৫ বছরের যাজকীয় জীবনের অভিজ্ঞতার সম্বন্ধে সহভাগিতা করেন ফাদার জ্যোতি এফ. কস্তা। তিনি সাধু জন মেরী ভিয়ান্নীর উদ্বৃতি দিয়ে বলেন- যাজকত্ব হলো যিশু হৃদয়ের ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসাপূর্ণ হৃদয় দিয়ে একজন যাজককে তাঁর ভক্তমণ্ডলির কথা শুনতে হবে। কেননা, যিশুর ভালোবাসাপূর্ণ হৃদয় নিয়ে একজন যাজককে তাঁর যাজকীয় জীবনে সেবাদান করার জন্য সকলকে উৎসাহিত করেন। সেইসাথে আমাদের এটাও মনে রাখতে হয় যে, আমি কী ধরনের যাজক হওয়ার ইচ্ছা পোষন করি! সর্বোপরি, একজন যাজকের জীবন হবে খ্রিস্টকেন্দ্রিক জীবন। বিকালের অধিবেশনে “অংশগ্রহণকারী মণ্ডলিতে একজন যাজকের ভূমিকা” এই বিষয়ে কথা বলেন ফাদার দিলীপ এস. কস্তা। তিনি বলেন- মণ্ডলি প্রেরণধর্মী এবং এই প্রেরণকাজে আমরা সবাই অংশগ্রহণ ও সাক্ষ্যদান করতে আহুত।
২৭ জুলাই সকালে শিশু সুরক্ষা, শিশু নির্যাতন, শিশু বা অপ্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতি যৌন হয়রানি, মণ্ডলির বিধিবদ্ধ আইন ও নির্দেশনা এবং প্রক্রিয়াগত সুনির্দিষ্ট পন্থা সম্পর্কে আলোচনা করেন ফাদার মিন্টু লরেন্স পালমা। তিনি বলেন- শিশু অধিকার সুরক্ষা ও শিশু নির্যাতন বর্তমান বিশ্বে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত বিষয়। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে শুরু করে প্রতিটি দেশ, বিভিন্ন সংস্থা, কাথলিক সার্বজনীন মণ্ডলি, স্থানীয় মণ্ডলি সামগ্রিকভাবে সব পর্যায়ে এই বিষয়টা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছে। এজন্য এই ব্যাপারে এবং এই লক্ষ্যে সচেতনমূলক বিভিন্ন প্রোগ্রাম-পলিসি, শিশু নির্যাতন প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক হিসেবে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা ও বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে UNICEF, UNCRC, বাংলাদেশ শিশু এ্যাক্ট ২০১৩-তে এই ব্যাপারে পলিসি ও বিভিন্ন আইনী নির্দেশনা রয়েছে। সর্বোপরি মাতামণ্ডলি শিশু নির্যাতন-এর বিধ্বস্তপূর্ণ অবস্থা স্বীকার করে নিয়ে বর্তমানে এই শিশু অধিকার সুরক্ষার যে একটা ‘global challenge’ হয়ে আছে তার জন্য কাথলিক মণ্ডলি এই ব্যাপারে যারপর নাই উদগ্রীব এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে বলিষ্ঠভাবে সোচ্চার। যার জন্য মণ্ডলি বিগত কয়েক বছরে ডজন খানেক পত্রাবলী, নির্দেশনাবলী, বিধানাবলী প্রকাশ করেছেন, ঘোষণা করেছেন। এর উপর ভিত্তি করে আমাদের দেশে কাথলিক বিশপ সন্মেলনী (CBCB) এবং প্রতিটি ধর্মপ্রদেশ, এমনকি বিভিন্ন সংঘ-প্রতিষ্ঠান ‘শিশু অধিকার সুরক্ষা পলিসি’ প্রণয়ন করেছেন।
বিকাল ৩:৩০ মিনিটে অনুষ্ঠিত হয় যাজক ভ্রাতৃসংঘের এজিএম। এতে প্রথমভাগে ধর্মপ্রদেশীয় যাজক ভ্রাতৃসংঘের সচিব ফাদার শিশির নাতালে গ্রেগরী বিগত সম্মেলনের প্রতিবেদন পেশ করেন। একই সাথে হিসাব-নিকাশ প্রদান করেন। অতঃপর যাজকবর্গের সভার সকলের সম্মতিক্রমে পুরাতন কার্যনির্বাহী পরিষদকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন এবং পরে নতুন কার্যকরী পরিষদের জন্য সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন ফাদার মিন্টু লরেন্স পালমা (ঢাকা), সহসভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন ফাদার উইলিয়াম মুরমু (রাজশাহী) এবং সেক্রেটারী হিসেবে নির্বাচিত হন ফাদার রুবেন (ঢাকা)।
যাজক ভ্রাতৃসংঘের মিলনমেলার সমাপনী খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের আর্চবিশপ বিজয় ডি’ক্রুশ, ওএমআই। তিনি তাঁর উপদেশে বলেন- সিনোডাল মণ্ডলি গঠনের জন্য বিশেষ কিছু দিকের উপর গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। এই সিনোডের মধ্যদিয়ে পুণ্যপিতা পোপ মহোদয় আমাদেরকে বলতে চান যে, সবার আগে আমরা যেন, আমাদের সবার সার্বিক মঙ্গল নিয়ে চিন্তা করি। কেননা, জনকল্যাণমূলক কাজ বা সকলের মঙ্গল কামনা করাই হচ্ছে খ্রিস্টসেবক হিসেবে আমাদের সকলের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য।
সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটে ফ্যালোশীপ সান্ধ্যভোজের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ ধর্মপ্রদেশীয় যাজক ভ্রাতৃসংঘের মিলনমেলার সমাপ্তি হয়।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : বাবলু সি. কোড়াইয়া