গত ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ রোজ শুক্রবার রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের অন্তর্গত মথুরাপুর সাধ্বী রীতা ধর্মপল্লীর কাতুলী উপ-ধর্মপল্লীতে যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্য্য পরিবেশে সাধু আন্তনীর পর্বোৎসবটি পালিত হয়েছে। এই তীর্থোৎসবের পূর্ব প্রস্তুতিস্বরূপ নয় দিনের নভেনা, পাপস্বীকার সংস্কারগ্রহণ ও খ্রিস্টযাগের মাধ্যমে খ্রিস্টভক্তগণ তাদের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এ নভেনা অনুষ্ঠানে আশে-পাশের বিভিন্ন ধর্মপল্লী থেকে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন দল এসে তাদের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
সকাল ১০:০০ মিনিটে শোভাযাত্রা সহযোগে পবিত্র খ্রিস্টযাগ শুরু হয়। পবিত্র খ্রিস্টযাগে পৌরহিত্য করেন বরিশাল ধর্মপ্রদেশের পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও। এছাড়াও ১৫ জন যাজক, ১০ জন সিস্টার ও প্রায় ৩৫০০ খ্রিস্টভক্ত খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করেন।
বিশপ মহোদয় পর্বীয় মহাখ্রিস্টযাগের উপদেশে বলেন, প্রথমেই আমরা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি। কারণ, তিনি অনেক অনুগ্রহ আমাদেরকে দিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন ভাবে। খ্রিস্টমণ্ডলিতে সাধু আন্তনী’র প্রতি মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধা অনেক বেশি। বিশেষভাবে বাংলাদেশে আর সেজন্যেই যেখানেই সাধু আন্তনী’র এই পর্ব উদযাপিত হয়, তীর্থ হয়, সেখানেই আমরা ছুটে যাই এবং তার মধ্যদিয়ে আমরা অনুগ্রহ লাভও করি। আর সেজন্যে তার প্রতি ভক্তি নিবেদনার্থে আমরা ছুটে আসি বিভিন্ন মানত নিয়ে এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে। আজকেও এসেছি সেই একই বিশ্বাসে, একই আস্থা নিয়ে। আমরা ঈশ্বরের কাছে সাধু আন্তনী’র মধ্যদিয়ে সেগুলো উৎসর্গ করব এবং তার অনুগ্রহ লাভ করব বলে বিশ্বাস আছে। আজকে আমরা যে তিনটি বাণী পাঠ শুনেছি এবং এই বাণীপাঠগুলো যদি সাধু আন্তনী’র জীবনের সাথে মিলাই তাহলে দেখতে পাই যে, সাধু আন্তনী’র জীবন সত্যিকারভাবে ঐশবাণীর একটি জীবন্ত প্রতিফলন।
ঐশ প্রজ্ঞার কথা বলা হয়েছে। কারণ, ঐশ প্রজ্ঞাকে আমি ভালোবাসি। ঐশ প্রজ্ঞা অনেক সুন্দর। তাহলে সেই প্রজ্ঞা পাবার একটা বাসনা কি আমাদের অন্তরে পোষণ করি? নতুন নিয়মে ঈশ্বরের সেই প্রজ্ঞা হলেন স্বয়ং যিশুখ্রিস্ট। সেজন্যেই এই সেই সাধু আন্তনী’র কোলে আমরা দেখতে পাই শিশু যিশু যাকে তিনি আলিঙ্গন করেছিলেন। ঐশ প্রজ্ঞা যার জন্য প্রার্থনা করেছেন সেই জীবন্ত প্রজ্ঞা তার হাতে। কারণ, যিশুকে তিনি ভালোবেসেছেন। যিশুর প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস ছিল এবং যিশুর সাথে প্রার্থনায় তার একটি গভীর একাত্বতা ছিল। দ্বিতীয় পাঠে আমরা শুনি, সাধু পল বলেছেন, নিজের সম্পর্কে যে ধারণা থাকার কথা তার চেয়ে বেশি উচ্চ ধারণা বা ভিন্ন ধারণা যেন না থাকে। আমরা নিজেকে নিয়ে অনেক কিছু ভাবি; বাস্তবে যদিও আমরা তা নই, যতটুকু নই, তারচেয়েও বেশি ভাবি। কিন্তু সাধু পল বলেছেন, তুমি যতটুকু, ততটুকুই নিজেকে মনে করবে এরচেয়ে বেশি নয়। আর সাধু আন্তনী ততটুকু মনে হয় ভাবেননি তার সম্পর্কে; একটু কমই ভেবেছেন কিন্তু ঈশ্বর তাকে অনেক দিয়েছেন। সাধু আন্তনী ছিলেন এতো বিনয়ী, এতো নম্র এবং কোমল প্রাণ মানুষ, যে তিনি নিজের সম্পর্কে কখনো উচ্চ ধারণা পোষণ করেন নি। সাধু পল বলেছেন, মঙ্গলময় ঈশ্বরের যে অনুগ্রহ দান তোমরা পেয়েছো, সেগুলো মানুষের মঙ্গলের জন্যে ব্যবহার কর। সাধু আন্তনীর জীবনে আমরা সেটাই দেখেছি; যে অনুগ্রহ দান তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে পেয়েছেন, সে অনুগ্রহ দিয়ে তিনি মানুষের হৃদয় দ্বারে পৌঁছতে পেরেছেন। মানুষের কল্যাণ সাধন করেছেন। আর সেজন্যেই সাধু আন্তনী’র একটি পরিচয় হলো তিনি ছিলেন অলৌকিক কর্মসাধক। তার মধ্যদিয়ে অনেক অলৌকিক কর্ম সাধিত হয়েছে এই পৃথিবীতে মানুষের জীবনে। সেই অনুগ্রহগুলো তিনি ব্যবহার করেছেন এবং অনুগ্রহ দ্বারা তিনি মানুষের কল্যাণ করেছেন। যেখানে দীন-দরিদ্র মানুষ, কষ্ট-ক্লিষ্ট মানুষ, অসহায় মানুষ সেখানেই তিনি। যেখানে মানুষের আকুল আকুতি-মিনতি, প্রার্থনা-কান্না, সেখানে তিনি তার দরদী হৃদয় নিয়ে উপস্থিত এবং তাদের জীবনকে পূর্ণতা দিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, আজকে সাধু আন্তনী’র কয়েকটি বৈশিষ্ট আমরা নিয়ে যাই। ঐশ বাণী তিনি কিভাবে পাঠ করেছেন আজকে থেকে আমি আমার পরিবারে সেইভাবে যেন বাণী পাঠ করতে পারি তার জন্যে আসুন একটা সংকল্প নেই। দ্বিতীয়ত: প্রার্থনার জীবনে, সাক্রামেন্তীয় জীবনে এবং খ্রিস্টপ্রসাদের প্রতি ভক্তি আমরা কিভাবে বাড়াতে পারি; সেই বিষয়ে সচেতনভাবে চিন্তা করি, ধ্যান করি এবং তা নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করার জন্য একটা সংকল্প গ্রহণ করি। পারিবারিক প্রার্থনায় আমরা যেন নিষ্ঠাবান থাকি, নিয়মিত খ্রিস্টযাগে আসি, যিশুকে বিশ্বাস নিয়ে গ্রহণ করি আমাদের ভিতরে যেই অনুগ্রহ দান সেইগুলো আমরা এগুলোর মাধ্যমেই ব্যবহার করতে পারব। আর তৃতীয়ত: আমরা যেন দেখি আমার মধ্যে ভাল কি আছে, যেটা দিয়ে আমি অন্যের ভাল করতে পারি। আমি স্বার্থপর হব না। ঈশ্বর আমাদেরকে দিয়েছেন বিনামূল্যে আমি যেন বিনামূলেই অন্যদের জন্য সেই অনুগ্রহ দান গুলো ব্যবহার করতে পারি। তার অন্যান্য আদর্শ ও গুণগুলোকে আমরা যেন অনুসরণ করি। সাধু আন্তনী আজকে আমাদের প্রার্থনা শুনছেন। বিভিন্ন উদ্দেশ্য আছে মনে সেগুলো আমরা তার কাছে তুলে ধরছি এবং আমাদেরকে তিনি সত্যিই রূপান্তরিত করতে পারবেন এবং আমাদের জীবনে সুখ শান্তি দান করবেন এই বিশ্বাস নিয়ে আসুন খ্রিস্টযাগে প্রার্থনা করি।
তীর্থ উৎসবের উপাসনা কমিটির সদস্যা মিসেস সাগরী গমেজ তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন- যখন থেকে তীর্থের ঘোষণা হয়েছে তখন থেকেই ভিতরে একটা আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। সাধু আন্তনীর তীর্থে এতো মানুষের সমাগম এবং প্রার্থনাপূর্ণ অনুষ্ঠান যেটা আমরা অন্য সময়ে পাই না। তবে নয়দিন আগে যখন নভেনা হয় তখন থেকেই আমরা প্রস্তুতি শুরু করি । এই নভেনার মধ্যে প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন প্যারিশ থেকে ফাদারগণ আসেন আধ্যাত্মিক পরিচালনা দান করেন। খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করা হয়। আর এভাবেই আমরা নিজেদেরকে আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করি এবং পাপস্বীকারের মধ্যদিয়ে নিজ জীবনে পাপের ক্ষমা লাভ করি। পর্বীয় খ্রিস্টযাগে এতো ভক্তজনগণের সমাগম হয় যে, আমাদের সাধু আন্তনীর তীর্থোৎসবের জন্য যেন এই স্থানটি আরো মুখরিত হয়ে উঠে। এই তীর্থোৎসবে সকলে মাঝে খ্রিস্টের বাণী প্রচার হয়েছে, খ্রিস্টকে আমরা বিশ্বাস করি। খ্রিস্টের বাণী আমরা যেন বাড়ি নিয়ে যেতে পারি এবং অনুসরণ করতে পারি। সাধু আন্তনীর ঐশ অনুগ্রহ গুণটি আমার ভাল লাগে। তার কাছে প্রার্থনা করে আমি সুস্থ হয়েছি। আমার পরিবার এবং যারা আত্মীয় স্বজন আছে সবার জন্য প্রার্থনা করি তার এই গুণটি পাবার জন্য। আমরা অনেক ফল পাচ্ছি। সকলকে ধন্যবাদ।
৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার রোকন উদ্দিন তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন- পানজোরা যেমন এই অনুষ্ঠান বা প্রোগ্রামের জন্য পরিচিত আমি চাই সারা পৃথিবীতে কাতুলীর এই সাধু আন্তনীর তীর্থ উৎসব পরিচিত হোক।
পাল-পুরোহিত ফাদার শিশির গ্রেগরী শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন- আমি সত্যিই আজ খুবই আনন্দিত যে, কাতুলীতে মহান সাধু আন্তনীর এই তীর্থোৎসব সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি। আমি সর্বপ্রথমে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই ঈশ্বরের সহায়তায় আজকের এই দিনটি আমরা সবাই একসঙ্গে সাধু আন্তনী’র মধ্যস্থতায় প্রার্থনা করছি যেন অনুগ্রহ লাভ করতে পারি। আমি ধন্যবাদ জানাই এবং কৃতজ্ঞ অন্তরে পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ ইম্মানুয়েল কানন রোজারিও, ধর্মপাল, বরিশাল ধর্মপ্রদেশকে এই পর্বীয় মহাখ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করার জন্যে। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই সকল ফাদার এবং সিস্টারদের আপনাদের উপস্থিতি আজকের এই তীর্থের আনন্দ ও আশীর্বাদ আরো বাড়িয়ে তুলেছে। আমি শ্রদ্ধেয় ফাদারগণকে আমাদের মথুরাপুর ধর্মপল্লীর সকলের পক্ষ থেকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। ধন্যবাদ জানাই শ্রদ্ধেয় ফাদার উত্তমকে যিনি কয়েকদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এই তীর্থ উপলক্ষ্যে। ধন্যবাদ জানাই সিস্টার ঈশিতা এবং মথুরাপুর ধর্মপল্লীর যুবক-যুবতী ভাইবোনদের যারা সাজ-সজ্জার কাজ এবং অন্যান্য সাহায্য-সহযোগীতা করেছেন তাদের সকলকে। ধন্যবাদ জানাই গানের দলকে বিশেষ করে আগষ্টিন স্যার এবং সাগরী দিদিমণিকে তাদের নেতৃত্বে আজ সুন্দর গান এবং নৃত্য পরিবেশনার জন্য। ধন্যবাদ জানাই পালকীয় পরিষদের সকল সদস্য-সদস্যাকে যারা ওতোপ্রোতভাবে এ পর্ব উপলক্ষ্যে জড়িত আছেন ও সহায়তা করছেন। সর্বোপরি ধন্যবাদ দেই আপনাদের সকলকে যারা এই ভিকারিয়াসহ আমাদের ধর্মপ্রদেশ এবং অনেক মানুষ ঢাকা থেকেও এসেছেন আপনাদের প্রত্যেককে। আপনাদের উপস্থিতিই প্রকাশ করছে যে আপনারা সাধু আন্তনীর ভক্ত। আপনাদের উপস্থিতি এই তীর্থ খ্রিস্টযাগ সবকিছুই আরো অর্থপূর্ণ করে তুলেছে। সেই সাথে আজ প্রার্থনা করি যেন, সাধু আন্তনী আমাদের প্রত্যেককে অনেক আশীর্বাদ করেন এবং আমরা যেন তার মধ্যস্থতায় ঈশ্বরের আরো অনেক বেশি কৃপা পেয়ে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্বাসে বলীয়ান হতে পারি।
খ্রিস্টযাগের শেষ আশীর্বাদের আগে পর্বীয় বিস্কুট, প্রার্থনা কার্ড, অনুগ্রহ পত্রিকার উদ্বোধন ও খ্রিস্টভক্তদের নিয়ে আসা ধর্মীয় সামগ্রীর উপর বিশপ মহোদয় পবিত্র জল সিঞ্চনের মধ্যদিয়ে সেগুলোকে আশীর্বাদ করেন এবং পরে শান্তি ও আনন্দের প্রতীক হিসেবে বিশপ মহোদয় কবুতর উড়ান।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : ফাদার বাবলু কোড়াইয়া