ফাদার সুনীল রোজারিও, বরেন্দ্রদূত প্রতিবেদক।

সিনোডাল চার্চ নিয়ে নানাভাবে, আলোচনা, সেমিনার কম হয়নি। গত প্রায় দুই বছর ধরে বাংলাদেশের  ক্যাথলিক চার্চে বিষয়টি নিয়ে ছিলো কমন আলোচনা- মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ, অন্য কথায় একসঙ্গে যাত্রা। এই যাত্রায় প্রকৃতির অন্য কোনো প্রাণি বা বস্তুকে সহযাত্রী হিসেবে গণ্য করার আগে মানব জগতের বিষয়টি প্রথমে আসে। কারণ সৃষ্টির মঞ্চে মানব সন্তান হলেন শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। তাই চার্চের পালকীয় জীবনের মূল লক্ষ্য হলো মানব সন্তান। কিন্তু প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না। প্রকৃতিকে লালন-পালন করার দায়িত্ব ঈশ্বর মানব সন্তানের কাঁধে ন্যস্ত করেছেন। তাই সিনোডাল চার্চের এই যাত্রাপথ প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে নয়- প্রকৃতির মধ্যেই আয়োজন করতে হবে উৎসবগুলো- প্রকৃতিকে রক্ষা করে।

সিনোডাল মণ্ডলি এমন একটি চলমান পদ্ধতি, যার মধ্যদিয়ে  বিশপগণ যাজকদের নিয়ে আত্মিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে খ্রিস্টভক্তগণের সঙ্গে সহযোগিতার লক্ষ্যে খোলাখুলি আলোচনা করেন। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “একই ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে একসঙ্গে যাত্রা, যেন মণ্ডলি যে ঈশ্বরের দান, সে বিষয়ে সবাই মিলেমিশে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।” সিনোড বিশপদের ধর্মসভা হলেও পোপ সিনোডালিটি বলতে গিয়ে জোর দিয়েছেন “ভক্তসমাজ”কে। তিনি বলেছেন, “সিনোড কোনো সংসদ নয়, মতামত অনুসন্ধান করাও নয় কিন্তু “ভক্তসমাজ”- যার প্রাণ হলেন পবিত্র-আত্মা।” এই পবিত্র আত্মা যেন মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয় সেই জন্য এই সহযাত্রা, লেনদেন ও সহভাগিতা। যেন এর মধ্যদিয়ে ভক্তগণ ঈশ্বরের বাক্য ধ্যান করতে পারে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝতে পারে, যিশুর শিক্ষা হলো, “আত্মিক শক্তি ও জীবন।” ফলে ভক্তগনের মধ্যে যেন সঞ্চারিত হয় “প্রেরণ দায়িত্ব”। এই বিষয়ে সু-সংবাদ লেখক যোহন বলেন, “আত্মিক শক্তিই জীবন সঞ্চারী শক্তি … আমি যেসব কথা তোমাদের বললাম, সেসব কথাই তো আত্মিক শক্তি ও জীবন সঞ্চারী” (৬:৬৩)। সিনোডাল চার্চের দাবি হলো, ভক্তসমাজের মধ্যে আত্মিক ও জীবন সঞ্চারী শক্তি জাগ্রত করা- যেন তারা বাণী প্রচারে আগ্রহী হয়ে ওঠে- যেন মণ্ডলির হয়ে ঈশ্বরের রাজ্যে খ্রিস্টের সাক্ষ্য বহন করতে পারে।

কানাডার কার্ডিনাল মিশেল সিজেরনি বলেছেন, “ Synodality is the way for Integral Human Development”  অর্থাৎ সিনোডালিটি হলো, “সমন্বিত মানব উন্নয়ন” পথে যাত্রা। সমন্বিত মানব উন্নয়ন অর্থ- আন্তঃব্যক্তিক উন্নয়ন। পোপ ৬ষ্ঠ পৌল থেকে শুরু আজ পযর্ন্ত সব পোপ এবং চার্চের বিধায়কগণ সমন্বিত মানব উন্নয়ন নিয়ে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। সমন্বিত মানব উন্নয়ন মানে নয় শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনীতি, প্রতিপত্তি বা আধুনিক সভ্যতা। এই প্রসঙ্গে কার্ডিনাল বলেন, “Synodality offers is a valid way forward to promote the God-given human dignity of all people” যার মানে হলো, মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের দেওয়া মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা সিনোডের একটি বৈধ আহ্বান। মানুষ, প্রতিষ্ঠিত রাজনীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক বিভাজনের কারণে তার পাওনা মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। “মানব উন্নয়ন” প্রৈরিতিক পত্রে পোপ ৬ষ্ঠ পৌল বলেছেন, “উন্নয়ন নিছক অর্থনৈতিক উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যথার্থতার জন্য উন্নয়নকে হতে হবে পূর্ণাঙ্গ: যেটা হলো সমন্বিত- যেটা প্রত্যেক ব্যক্তির ও পুরো ব্যক্তির মধ্যে উত্তম অগ্রগতি সাধন করে।”

“সমন্বিত মানব উন্নয়ন” নিয়ে সিনোডাল মণ্ডলি কী বলতে চায়? The Church’s commitment  to promoting  integral human development. সিনোডাল চার্চ বলতে চায় যে, মণ্ডলির দায়িত্ব হলো সমন্বিত মানব উন্নয়ন প্রতিষ্ঠা করা। ভাটিকানের বিধায়ক মুন্সিনিয়র লুসিও রুইজ বলেন, “Involves observing contemporary culture, being connected to contemporary men and women, and wanting to communicate the Lord’s  Message with their language in the places where they live”.। সমকালীন সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণ করা ও সমকালীন সময়ের  নারী-পুরুষ হিসেবে, মানুষ যেখানে যে ভাষা-সংস্কৃতিতে বসবাস করে তাদের সঙ্গে সেভাবে প্রভুর বার্তা দিয়ে যোগাযোগ করা। এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে- নতুন উপায়ে পালকীয় কাজের জন্য পরিবর্তনশীল যুগ-সংস্কৃতিকে গ্রহণ করাকে। আর একটি বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, আর তা হলো, “To enter into this dynamic of mutual listening, accompaniment and mutual service”, অর্থাৎ প্রাণবন্তভাবে পারস্পরিক শ্রবণ, সহযাত্রা এবং পারস্পরিক সেবা। সিনোডাল চার্চ নিয়ে আমরা যতোই আলোচনা করি না কেনো- প্রাথমিক লক্ষ্য হলো প্রকৃত খ্রিস্টভক্ত হয়ে ওঠা।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে- গত দু’বছরের আলোচনা, সভা সেমিনার, কর্মশালার মধ্যদিয়ে এই সমন্বিত মানব উন্নয়ন কতোটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- তা মূল্যায়ন করার প্রয়োজন রয়েছে। বহুমুখী আলোচনার পর চার্চের পালকীয় জীবন ও ভক্তগণের জীবনে কতোটুক পরিবর্তন এসেছে- এমন একটা প্রশ্ন সামনে আসে। ফলে সমন্বিত মানব উন্নয়ন কতো ধাপ এগিয়েছে। সমন্বিত মানব উন্নয়ন প্রশ্নে যে ক্ষেত্রগুলো বিবেচনায় আনতে হবে সেগুলো হলো- ভক্তগণের মধ্যে পারস্পরিক খ্রিস্টীয় সামাজিক জীবন, আদর্শ পরিবার গঠন, “আমার ধর্মপল্লী আমার দায়িত্ব” এই বিষয়ে জনগণের উপলব্ধি কতোদূর এগিয়েছে, ধর্মের প্রতি যাদের অনীহা- তাদের মধ্যে কতোভাগ ধর্মমুখী হয়েছে, সাক্রামেন্তীয় জীবন কতো মজবুত হয়েছে, অন্যের সঙ্গে সংলাপ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, অন্যকে হৃদয়ের কান দিয়ে শ্রবণ করা, দরিদ্রদের প্রতি হাত বাড়িয়ে দেওয়া, ইত্যাদি, বিষয়গুলো  যখন একজন ব্যক্তির পুরো সত্ত্বাকে অনুপ্রাণিত করে পরিবর্তন করে- সেটাকে বলতে পারি, সমন্বিত মানব উন্নয়ন।

সমন্বিত মানব উন্নয়ন শুধু কিছুদিনের জন্য সিনোডাল মণ্ডলির দাবি নয়- এটা মণ্ডলির জীবন, খ্রিস্টভক্তগণের জীবন। এই সমন্বিত মানব উন্নয়ন বিষয়টি শুধুমাত্র সিনোডাল চার্চের আলোচনার বিষয় নয়- এটা মণ্ডলির একটা দীর্ঘমেয়াদি এ্যাজেন্ডা, মণ্ডলির প্রধান পালকীয় কাজ। সিনোডালিটি নিয়ে বিশপদের সিনোড সভা  আগামী বছর অক্টোবরে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু সেই সঙ্গে শেষ হয়ে যাবার কথা নয় সিনোডাল চার্চ আন্দোলন। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে খ্রিস্টমণ্ডলি ছোটো একটি সমাজ- সেখানে একসঙ্গে যাত্রা বা সহযাত্রা ভক্তসমাজের মধ্যে নিরাপত্তা, উৎসাহ বাড়াবে। তার আগে মণ্ডলির কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তৃণমূল পর্যায়ে পরিবর্তন আনার জন্য আগামীদিনের সিনোডাল চার্চ নিয়ে টেকসই পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। যে পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হবে মানব সমাজকে ঘিরে। কার্ডিনাল মিশেল সিজেরনি যেটাকে বলেছেন, “Integral Human Development”  অর্থাৎ, “সমন্বিত মানব উন্নয়ন”। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।

Please follow and like us: