খ্রিস্টবিশ্বাসের যাত্রায় মানুষের জীবনে বিভিন্ন অলৌকিক কার্য সাধনের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠে তীর্থস্থান। খ্রিস্ট যিশু, মা মারিয়া, সাধু যোসেফ, সাধু-সাধ্বীগণ ও তাঁদের আর্শ্চয কাজকে স্মরণ করেই ভক্তমণ্ডলি তীর্থোৎসবে অংশগ্রহণ করেন। মানতাকাঙ্খী ও মানত পূরণার্থী ও পুণ্যার্থীগণ তীর্থোৎসবে অংশগ্রহণ করেন ও ধ্যান-প্রার্থনা করে আশির্বাদ লাভ করে থাকেন। সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশ মণ্ডলিতে উল্লেখযোগ্য যে কয়েকটি তীর্থস্থান গড়ে উঠেছে সেগুলোর রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের মধ্য ভিকারিয়ার নবাই বটতলা রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার তীর্থস্থান অন্যতম।
মায়ের প্রতি বিশ্বাস ও আকুল প্রার্থনা
স্বাধীনতা যুদ্ধে এলাকার হাজার হাজার মানুষ প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু নবাই বটতলা গ্রামের লোকজন গ্রাম থেকে কোথাও পালিয়ে না গেলেও সবার চোখে মুখে অজানা আশঙ্কা ও মৃত্যুভয়। এমন পরিস্থিতিতেই তারা এক রাতে গ্রামসভা ডাকলেন। গ্রাম সভায় লক্ষণ মাস্টার সবাইকে বললেন, “আমরা সবাই প্রতিদিন রোজারীমালা প্রার্থনা করব।” সাহসী লুইস মাস্টার জানালেন, “মিশরের দাসত্ব থেকে ইস্রায়েল জাতিকে ঈশ্বর বাঁচিয়েছিলেন। আমরাও যদি প্রার্থনা করি তাহলে নিশ্চয় মা মারিয়া এবং ঈশ্বর আমাদেরও বাঁচাবেন।” ধর্মপ্রাণ লক্ষণ মাস্টার সবাইকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমরা কুমারী মারিয়ার কাছে মানত করি, যদি সত্যি সত্যিই সমূহ বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাই তাহলে প্রত্যেক বছর আমরা মা মারিয়ার নামে ধন্যবাদের পর্ব পালন করব।”
সেদিন সাহসী ও ধর্মপ্রাণ দুই মাস্টারের অভয় বাণী ও ধর্মীয় বিশ্বাস সবাইকে সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। সেদিনের গ্রামসভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরের দিন রবিবারে গির্জায় গির্জা পরিচালক লক্ষণ মাস্টার ঘোষণা করেন, “আমরা প্রতিদিন রোজারীমালা প্রার্থনা করে মা মারিয়াকে বলবো- “মা তুমি যদি তোমার সন্তানদের এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা করো, তাহলে প্রত্যেক বছর আমরা তোমার নামে পর্ব পালন করবো।” তিনি সবাইকে অভয় দিয়ে আরও ঘোষণা করেছিলেন, “আমরা কেউ গ্রাম ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাবো না। মরতে যদি হয় গ্রামের লোক সকলে এক সাথে মরবো। কোনদিন যদি রাজাকার, আলবদর অথবা পাকবাহিনী গ্রামে আসে তবে ঘন্টা বাজানো হবে এবং ঘন্টা শোনামাত্র সবাইকে গির্জা ঘরে এসে সমবেত হতে হবে।”
শত মানুষের জীবন রক্ষাকারিণী মা মারিয়া
গ্রাম সভার সিদ্ধান্ত এবং গির্জায় ঘোষণার ২/৩ দিন পর সকালের সূর্য সবেমাত্র পূর্বাকাশে দেখা দিয়েছে এমন সময় গ্রামবাসীরা দেখতে পেল গ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে প্রায় ১০০ জনের মত পাকসেনা ও আলবদর রাজাকারেরা নবাই বটতলা গ্রামের দিকে আসছে। রাজাকারদের আসতে দেখে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গির্জার ঘন্টা বাজানো হলো। ঘন্টা শুনে গ্রামের লোকজন সবাই দ্রুত গির্জাঘরে এসে সমবেত হলো। তারা গির্জায় মা মারিয়ার নিকট রোজারীমালা প্রার্থনা করতে লাগলো। গির্জা ঘরে চারটি জানালা ও দুইটি দরজা ছিল। চারটি জানালায় দু’জন করে এবং দুই দরজায় দু’জন করে খান সেনা রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে থাকে; যেন কেউ গির্জা ঘর থেকে বের হতে এবং পালাতে না পারে।
এরপর গির্জার ভিতরে প্রবেশ করে প্রায় ছয়জন খান সেনা। খান সেনারা গির্জায় প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান করতে থাকে। গির্জা ঘরে অবস্থানরত কয়েক জনকে তারা রোজারী প্রার্থনা ও ক্রুশের চিহৃ করতে বলে। প্রাণভয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল বেশকিছু হিন্দু ও মুসলমান নারী পুরুষ। তারা প্রার্থনা ও ক্রুশের চিহ্ন করতে আসলেই জানত না। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে লক্ষণ মাস্টার খানদের প্রশ্নের উত্তর দেন যে, “আসলে তারা এত বেশি ভয় পেয়েছে যে, তারা কথা বলতেই পারছে না।” জীবন মরণের এই সন্ধিক্ষণে সবাই পিতা, পুত্র, পবিত্র আত্মার নামে ক্রুশের চিহ্ন করে রোজারী প্রার্থনা করতে থাকে। খান সেনারা গির্জা ঘরের ভিতরে আর কোন রকম বাড়াবাড়ি না করে ১০/১২ জন সাঁওতাল যুবককে ধরে নিয়ে চলে যায়। তাদের মধ্যে গুংড়া, পাগান, শিমন সরেন, মিখায়েল কিস্কু এবং বাকীরা ছিল অন্যান্য গ্রাম থেকে এখানে এসে আশ্রয় গ্রহণকারী যুবক।
খান সেনারা আদিবাসী সাঁওতাল যুবকদের ধরে গ্রামের পূর্ব দিকে রওনা হলো। এরই মধ্যে আন্ধারকোঠা মিশনের ইটালিয়ান ফাদার আঞ্জেলো মাজ্জনী সাইকেলে চড়ে নবাই বটতলায় চলে আসেন। তিনি নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে অসীম সাহস ও ঝুঁকি নিয়ে উপস্থিত হন। তিনি জানতেন, এই অবস্থায় খান সেনাদের সামনে দাঁড়ানো কোন ভাবেই নিরাপদ নয়। কিন্তু যে মানুষগুলো আজ চরম নিরাপত্তাহীনতা এবং ভয়াবহ অবস্থা ও নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি, এমন সময় তাদের পাশে দাঁড়াতে না পারলে মানব সেবার যে মহান ব্রত নিয়ে তিনি সুদূর ইটালী থেকে এদেশে এসেছেন সে উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যর্থ বলে প্রতিয়মান হবে মর্মে তিনি বিবেকের প্রশ্নবানে বিদ্ধ হয়েছিলেন। তাই সব ভয়-শঙ্কা ভুলে তিনি পাক সেনাদের সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলেন, “এরা সবাই আমার লোক, আমরা খ্রিস্টান, তাই আমার লোকদের কারো যেন কোন ক্ষতি না হয়।” ফাদারের কথা শুনে একজন সেনা রেগে গিয়ে ফাদারের গালে সজোরে দুই তিন চড় মারে এবং তাঁর সাইকেলটি কেড়ে নেয়।
নির্ভীক ফাদার মাজ্জনী যেন আরো বেশি সাহসী হয়ে উঠলেন। তিনি খান সেনাদের দল নেতার সাথে কথা বলতে লাগলেন। এদিকে আলবদর রাজাকারেরা খান সেনাদের সহায়তায় বিভিন্ন বাড়ীতে টাকা-পয়সা, থালা বাসন, ঘটি বাটি লুটপাট শুরু করে। গ্রামের নামো পাড়ার দিকে যে কয়জনকে ধরা হয়েছিল তাদেরকে গুলি করে মারার জন্য লাইনে দাঁড় করানো হয়। ফাদার মাজ্জনীর বুদ্ধিমত্তার কারণে খান সেনারা তাদের গুলি না করে ছেড়ে দেয়। এদিকে যে ১০/১২ জনকে গির্জা ঘরের ভিতর থেকে ধরে গ্রামের পূর্ব দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ফাদারের সাহসী হস্তক্ষেপের কারণে তাদেরকেও খান সেনারা ছেড়ে দেয়।
১৬ জানুয়ারি রক্ষাকারিণীর মা মারিয়ার তীর্থোৎসব পালন
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা এবং দয়াময়ী রক্ষাকারিণী মা মারিয়ার সাহায্যে রক্ষা পাওয়ার জন্য শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানাতে গ্রামবাসী রক্ষাকারিণী মা মারিয়ার নামে একটি পর্ব পালনের দিন স্থির করে। গ্রামবাসী সবাই প্রথমে ১৬ ডিসেম্বর পর্বটি পালনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস একাধারে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের কারণে এবং সে সময় কৃষিজীবি আদিবাসীরা ধান কাটা, মাড়াই এবং সংগ্রহ কাজে ব্যস্ত থাকায় তারা ১৬ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ১৬ জানুয়ারি দিনটি রক্ষাকারিণী মা মারিয়ার নামে পর্ব পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে থেকে প্রতি বছর ১৬ জানুয়ারি রক্ষাকারিণী মা মারিয়ার পর্বটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। প্রথম দিকে মারিয়া পর্ব পালন শুধুমাত্র নবাই বটতলা গ্রামবাসী ও এলাকার জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে পালিত হলেও এখন নবাই বটতলা গ্রামটি রক্ষাকারিণী মা মারিয়ার পুণ্য তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। ফলে প্রতিবছর ১৬ জানুয়ারি দূর-দুরান্ত থেকে হাজার হাজার পুণ্যার্থী, খ্রিস্টভক্তরা এসে মিলিত হয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং মাতা-মারিয়ার চরণতলে তাদের মানত ও মনো প্রার্থনা নিবেদন করছেন।
আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি স্বরূপ নয়দিনের নভেনা
রক্ষাকারিণী মা মারিয়ার তীর্থকে কেন্দ্র করে নয়দিন ব্যাপী নভেনার মাধ্যমে মা মারিয়ার ভক্তগণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এই নয়দিন মধ্য ভিকারিয়ার ধর্মপল্লীগুলোর পরিচালনায় খ্রিস্টযাগ ও নভেনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিদিন অগণিত মানুষ দূর-দুরান্ত থেকে এসে মা মারিয়ার নভেনায় যোগদান করেন ও তাদের প্রার্থনা রক্ষাকারিণী মা মারিয়ার মধ্যস্থতায় যিশুর নিকট তুলে ধরেন।
পর্বীয় পবিত্র খ্রিস্টযাগ
নতুন বছরের শুরুতে ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ মহাসমারোহে পালিত হয় রক্ষাকারিণী মা মারিয়ার তীর্থোৎসব। তীর্থোৎসবের পূর্বের দিন রাতে আলোক শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর ফাদার যোহন মিন্টু রায় মা মারিয়ার বিষয়ে আলোকপাত করেন ও রাতে খ্রিস্টভক্তদের উপস্থিতিতে পবিত্র সাক্রামেন্তের আরাধনার আয়োজন ছিলো। তীর্থোৎসবে মহামান্য কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, সিএসসি, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও, ফাদার, ব্রাদার, সিস্টারসহ প্রায় বারো হাজার খ্রিস্টবিশ্বাসী উপস্থিত ছিলেন।
তীর্থোৎসবে পবিত্র খ্রিস্টযাগে পৌরহিত্য করেন মহামান্য কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, সিএসসি। খ্রিস্টযাগের শুরুতে বিশপ জের্ভাস রোজারিও সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, “আমরা খুবই আনন্দিত কারণ স্বর্গীয়া মা যিনি আমাদের রক্ষাকারিণী তাঁর কাছে আমরা এসেছি তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা জানাবার জন্য এবং আমাদের সকল মানত তার কাছে উৎসর্গ করতে।” পবিত্র খ্রিস্টযাগের উপদেশে মহামান্য কার্ডিনাল বলেন, “আমরা সবাই তীর্থযাত্রী। তীর্থযাত্রা করে আমরা এখানে এসেছি। কোন স্থান তখনই তীর্থ স্থান হয় যখন কোন পবিত্র কিছু ঘটিত হয়। ঈশ্বরের দর্শনের কারণে, পবিত্র মানুষের কারণে তীর্থস্থান হয়। নবাই বটতলা তীর্থস্থান হয়েছে কারণে এখানে পবিত্র ঘটনা ঘটেছে। যে ঘটনা এক সময় ছিল একটি গ্রামের তা হয়ে উঠেছে ধর্মপ্রদেশের। আমরা যারা তীর্থযাত্রী হয়ে এসেছি আমাদের প্রত্যেকের পরিবারে খ্রিস্টবিশ্বাসের গঠন ও অনুশীলন জরুরি।”
রক্ষাকারিণী মা মারিয়ার তীর্থে অংশগ্রহণ করে তাঁর ভক্তগণ আশির্বাদে ধন্য হয়ে কৃতজ্ঞ অন্তরে অনুভূতি ব্যক্ত করেন। নবাই বটতলা ধর্মপল্লীর প্রসঞ্জিত মারান্ডী বলেন, আমি ছোট থেকেই রক্ষাকারিণী মা মারিয়ার তীর্থোৎসবে অংশগ্রহণ করে আসছি। আমি অসুস্থ অবস্থায় মার কাছে প্রার্থনা করে সুস্থ হওয়ায় তাঁর প্রতি আমার বিশ্বাস জেগে উঠে। তাই প্রতিবছর এ তীর্থে এসে আমি আশির্বাদ কামনা করি যেন সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করতে পারি।
বোর্ণী ধর্মপল্লীর অরুনা স্বপ্নীল রোজারিও বলেন, এ বছর তীর্থোৎসব যথেষ্ঠ ভক্তিপূর্ণ ও আধ্যাত্মিকময় ছিল। আমি রক্ষাকারিণী মা মারিয়ার কাছে প্রার্থনা ও মানত করেছি, বিশ্বাস করি তিনি আমাকে সাহায্য করবেন ও আশির্বাদ করবেন।
মুশরইল সাধু পিতর সেমিনারী থেকে অংশগ্রহণকারী সেমিনারীয়ান ভূবন স্টিফেন কোড়াইয়া বলেন, প্রতি বছর রক্ষাকারিণী মা মারিয়ার তীর্থে ভীড় দেখে বুঝা যায় মা মারিয়ার ভক্তগণ যারা আসেন তারা তাঁর প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাস নিয়েই আসেন। আমিও বিশ্বাস নিয়ে এসেছি। প্রতিবারই মা মারিয়া আমার প্রার্থনা শুনেন ও পূর্ণ করেন।
নবাই বটতলা রক্ষাকারিণী মা মারিয়ার তীর্থোৎসব বাংলাদেশ মণ্ডলির জন্য একটি আশির্বাদ। ভক্তের প্রার্থনা ও বিশ্বাসের ফলে এ উৎসব আরো প্রসারিত হচ্ছে। ভক্তবিশ্বাসীগণ দিনে দিনে আরো বেশী রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার স্নেহাশীষ লাভ করছেন। প্রতিদিনের জীবনে রক্ষাকারিণী মা মারিয়াকে অভিজ্ঞতা করে মারিয়াভক্তগণ হয়ে উঠছেন পবিত্র।
বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : পিটার ডেভিড পালমা