ফাদার বিকাশ রিবেরু, সিএসসি

বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের অভিজ্ঞতা লাভ ও ঈশ্বরের সাথে যুবাদের সাক্ষাতের আকাঙ্খায় “আশার তীর্থযাত্রী” হিসাবে গত ২৭ জুলাই বাংলাদেশ থেকে বিশপীয় যুব কমিশনের তত্ত্বাবধানে কমিশনের প্রেসিডেন্ট বিশপ সুব্রত বি. গমেজ ও সেক্রেটারী ফাদার বিকাশ জেমস রিবেরু, সিএসসি’র নেতৃত্বে ২৮জনের একটি যুবদল রোমে যুব জুবিলী উৎসবে অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও জিজাস ইয়ুথদের কয়েকজন যুবকও এ বিশেষ জুবিলীতে অংশগ্রহণ করেছেন। বিশ্বজনীন মণ্ডলীর পুণ্যভূমি রোম নগরীতে জুবিলী উৎসব পালন করতে এবং এক প্রৈরিতিক মণ্ডলীর একতা প্রকাশ করতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন স্তরের বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গ মিলিত হচ্ছেন বিশ্বাসের তীর্থস্থান পুণ্যনগরী রোমে।

‘আশার তীর্থযাত্রা’ বিষয়টিকে প্রতিপাদ্য করে খ্রিস্টজন্মের ২০২৫ বছর স্মরণে জুবিলী উৎসব পালিত হচ্ছে স্থানীয় ও বিশ্বজনীন  মণ্ডলীতে। জুলাই এর ২৮ থেকে আগস্টের ৩, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে উদযাপিত হয় যুব জুবিলী। এটি বিশ্ব যুব দিবস নয়। জুবিলী বর্ষে বিশ্ব যুবাদের বিশেষ ‘জুবিলী উৎসব’। সাধু পোপ ২য় জন পলের উদ্যোগে কাথলিক মণ্ডলীতে বিশ্ব যুব দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে। প্রতি ২ থেকে ৩ বছর অন্তর অন্তর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ বিশ্ব যুব দিবস পালন করা হয়। প্রথম বিশ্ব যুব দিবস উদযাপিত হয় রোম নগরীতেই। ঐ সময়ে তের ভেরগাতা ছিল যুব দিবস পালনের অন্যতম স্থান। এ বছরও যুব জুবিলী পালনের অন্যতম প্রধান স্থান হলো সেই তের ভেরগাতা। বিশ্বের ১৫০টি দেশের ১০ লক্ষ যুবক-যুবতী এই জুবিলী উৎসবে অংশগ্রহণ করে।

আমাদের বাংলাদেশ খ্রিস্টমণ্ডলী যুবাদের জন্য রোমে জুবিলী ২০২৫ শুধু কেবলমাত্র ভ্রমণ বা বন্ধুত্ব দৃঢ় করার সুযোগই ছিল না, বরং বহু কঠিন চ্যালেঞ্জে ভরা গভীর ও তীব্র এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা ছিল। আশা করি, এই অভিজ্ঞতা সকল যুবাদের হৃদয়কে নতুন করে জাগিয়ে তুলবে। কারণ মণ্ডলী ও খ্রিস্টের সঙ্গে এই সাক্ষাৎ সবসময়ই প্রত্যেককে তার বিশ্বাসে একজন প্রধান চরিত্র হিসেবে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে এবং পরে তা নিজের মণ্ডলীতে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এটাই সেই বড় লক্ষণ যে এই তীর্থযাত্রীরা সত্যিই তীর্থযাত্রা সম্পন্ন করেছে এবং তারা নিজেদের সত্যিকারের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে।

এই যুবাদের জুবিলীতে আমরা অনুভব করেছি যে বেশিরভাগ তরুণ তীর্থযাত্রী গির্জায় আধ্যাত্মিক জীবনের ক্ষেত্রে উদাসীন বা আত্মতুষ্টি থেকে অনেক দূরে। আমরা জানি তারা একত্রে থাকলে আলাদা এক শক্তি পায় আর তা সত্যিই বিস্ময়কর। প্রশ্ন না করে উপায় নেই যদি তারা তাদের মাণ্ডলিক জীবনে এই একই শক্তি, আনন্দ ও উদ্দীপনা ঢেলে দিত তাহলে কী হতো? তারা প্রাণবন্ত, মনোযোগী, প্রার্থনায় নিমগ্ন, নিজেদের ইতিহাস বোঝার চেষ্টা করছে এক গির্জা থেকে আরেক গির্জায় ব্যাসেলিকা থেকে আরেক ব্যাসেলিকা, সাংস্কৃতিক মুহূর্ত থেকে প্রার্থনার মুহূর্তে সাক্ষ্য দিচ্ছে। মণ্ডলী তাদের উপর নির্ভর করতে পারে সেই শান্তি ও আশার প্রবক্তা হওয়ার জন্য যেটির জন্য পোপ লিও বহুবার আহ্বান করেছেন। যুবকদের আনন্দ ও প্রতিশ্রুতি, পোপ লিও চতুর্দশের বার্তা, আর খ্রিস্টের সঙ্গে ভাগ করা যাত্রা এক সপ্তাহকে শক্তি জুগিয়েছে, যা বহু স্মৃতি তৈরি করেছে, আর সেগুলো সবসময় তাদের হৃদয়ে থাকবে।

যুব জুবিলী উৎসবের প্রধান প্রধান ঘটনাবলী
রোমে প্রথম দিন, সোমবার ২৮ জুলাই, আমরা চেষ্টা করেছিলাম “টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় করে” সেন্ট পলের ব্যাসিলিকায় পৌঁছাতে। যেখানে আমরা পবিত্র দরজা দিয়ে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেছি। যুব তীর্থযাত্রী মিস প্রজ্ঞা গমেজের ভাষায় “পবিত্র দরজা পর্যন্ত পথ আমার জন্য ছিল অনেক বিশ্বাস, ইচ্ছাশক্তি, ধৈর্য আর তীর্থযাত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্যের পথ। আরেক যুবক চার্চিল এর ভাষায়, “পুরো অভিজ্ঞতাটি আমাকে অনেক কিছু থেকে মুক্ত করেছে এবং সত্যিই এটি আমার জন্য রূপান্তরমূলক ছিল আর এটা সত্যিই আশীর্বাদ যে আমরা এই সুযোগ পেয়েছিলাম।”

২৯ জুলাই সন্ধ্যায় সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে স্বাগত খ্রিস্টযাগে আর্চবিশপ রিনো ফিসিকেলার পৌরহিত্যে, সালেসিয়ান যুব ম্যুভমেন্টে জড়িতরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। রোদে দীর্ঘ সময় কাটানোর পর, উত্তেজনা আর ভিড়ের কারণে সৃষ্ট টানাপোড়নের মাঝখানে, আমরা সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে প্রবেশ করতে পারিনি। কিন্তু যতটুকু পেরেছি জুবিলীর উদ্বোধনী উদযাপন ও তরুণদের স্বাগত অনুষ্ঠানে অংশ নিলাম। এটি ছিল উচ্ছাস ও আনন্দে ভরা এক উদযাপন, যেখানে সারা বিশ্বের তরুণরা একত্রিত হয়েছিল। ভাটিকানের আর্চবিশপ রিনো ফিসিকেলা অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন, কিন্তু সবার বিস্ময় ও আনন্দের জন্য পোপ লিও এসে বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ তরুণদের উদ্দেশ্যে বললেন: “আজ, তোমরা ‘আশার জুবিলী’ করছ আর পৃথিবীর প্রয়োজন আশার বার্তা; তোমরাই সেই বার্তা এবং তোমাদের অবশ্যই সবার মাঝে আশা ছড়িয়ে দিতে হবে।”

সেই বিশাল ভিড়ের মাঝে বিভিন্ন বয়স ও জাতীয়তার মানুষ ছিল। সবাই অনুভব করলাম যে এটি ছিল তীর্থযাত্রার প্রকৃত সূচনা। কারণ এটি ছিল “খ্রিস্ট ও তাঁর বিশ্বাস উদযাপন করা।” অসংখ্য পতাকার সৌন্দর্য, যেগুলো বাতাসে দুলছিল, ঠিক যেমন গানের সুর, নাচ, আর তরুণদের চিৎকারে সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে উৎসবের পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল। মিস রেবেকা ত্রিপুরা’র অভিজ্ঞতায় “অবশেষে আমরা প্রথম পবিত্র দরজা অতিক্রম করতে পেরেছি, সেই আনন্দের পথে, যা কেবল ঈশ্বরের সঙ্গেই পাওয়া যায়।” সবকিছুই খুব সুন্দর ছিল, কিন্তু মূল বিষয় আমাদের যাত্রা ছিল প্রার্থনার, কোনো ধর্মীয় পর্যটনের নয়, অসংখ্য ছবির নয়, কিংবা ‘আত্ম-চিত্র’ পূজার নয়। আমরা যে পথ নিতে চেয়েছিলাম তা ছিল ঈশ্বরের সঙ্গে এবং ঈশ্বরের জন্য। এই জুবিলীর তীর্থযাত্রায় একটি বড় উদ্দেশ্য হলো ক্ষমাপ্রাপ্তি যা এই পূর্ণতার আকাক্সক্ষার ফলস্বরূপ।

৩০ থেকে ৩১ জুলাই: পুণ্য নগরী পরিদর্শন ও যুব সংলাপ

পুণ্য নগরী রোম কয়েকদিনের জন্য হয়ে উঠেছিল বহুত্বজাতীয়তাবাদী দেশ; যেখানে অসংখ্য ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর যুবাদের সমাগম ছিল। তীর্থযাত্রীরা যখন পুণ্য নগরীর মধ্য দিয়ে দলগতভাবে যাত্রা করছে, তখন তারা প্রকৃত খ্রিস্টিয় আনন্দের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। তরুণরা তাদের জীবন এবং জীবনযাত্রাকে ঈশ্বরের আহ্বানের প্রতি সাড়া হিসেবে দেখতে উৎসাহিত হয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও স্থানের মানুষের সাথে সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও আত্মিক সংলাপ পরিলক্ষিত হয়েছে। তাই বিশ্ব মণ্ডলী ও সমাজের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য যুবাদের মাঝে আন্তঃমাণ্ডলিক ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ অব্যাহত ছিল। জ্যোতি মূর্মু’র চোখে, “এই দিনের মহামূল্যবান সময়ে আমি অনুধাবন করলাম আমাদের তরুণ-তরুণীদের মনে যে হাহাকার, কান্না, চাপা কষ্ট, না বলা কথা ওরা বলতে চায়, তারা চায় তাদের কেউ বুঝুক, গ্রহণ করুক ও তাদের কথা শুনুক।”

ঐশরিয়া গুপ্তা’র দৃষ্টিতে, “আমি দেখেছি ওদের চোখের কোনে চিকচিক করে উঠা জল। বুঝতে পারলাম ওরাও ঈশ্বরকে খুঁজছে, ঈশ্বরকে দেখতে চায়, অনুধাবন করতে চায়।” সুমন হালদারের ক্যামেরায়, “দেখলাম তরুণ-তরুণীদের মুখে প্রশান্তির ছায়া। হয়ত এই বিশ্ব যুব জুবিলী বিশেষ করে এই শহরের তীর্থযাত্রার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে তরুণ-তরুণীদের অনেক কাছে এনে দিয়েছে, স্পর্শ করেছে অনেক আশাহত হৃদয়কে।” সত্যিই এটি কাথলিক মণ্ডলীর জন্য ধর্মীয় নেতা, আন্তঃধর্মীয় ও সামাজিক গোষ্ঠী, স্থানীয় সরকার এবং যুব প্রতিনিধিদের সাথে শোনার, সংলাপ করার এবং একসাথে চলার একটি দুর্দান্ত সুযোগ করে দিয়েছে। যাতে যুবারা কাথলিক মণ্ডলী সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, বিদ্যমান সম্পর্ক, চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগগুলো সম্পর্কে তাদের ধারণা প্রতিফলিত করতে এবং ভাগ করে নিতে পারে।

চিরকো মাস্সিমোতে ক্ষমা ও পুর্নমিলন অনুষ্ঠান

শুক্রবার, ১ আগস্ট ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিন। চ্যারর্কো ম্যাক্সিমো পার্কটি ছিল সেই প্রেমময় স্থান যেখানে ঈশ্বর আমাদের তরুণ তীর্থযাত্রীদের তাঁর ক্ষমা এবং করুণা অনুভব করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ঈশ্বরের ডাকে, পাপের ক্ষত এবং ক্লান্তি নিয়ে এই পার্কে প্রবেশ করে তরুণ তীর্থযাত্রীরা প্রভুর দ্বারা পুনরুত্থিত এবং পরিত্রাণ লাভের আনন্দ অনুভব করেছে। এটি ছিল ঈশ্বরের সাথে যুবাদের পুনরায় বন্ধুত্ব স্থাপনের সময়। আমাদের পাপের সঙ্গে ঈশ্বরের করুণার মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্ত। হাজার হাজার যুবক-যুবতী নীরবতা, মনোসংযোগ এবং ঈশ্বরের ক্ষমার জন্য উন্মুক্ত হৃদয়ে পাপস্বীকার সংস্কারীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। এই দিনটি আমাদের অনেকের জন্য করুণার এক গভীর অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যা ঈশ্বরের ব্যক্তিগত ভালোবাসা ও দয়ার অর্থকে পুনর্ব্যক্ত করেছে।

আন্তনী ইভান্সের ভাষায়, “কাঙ্খিত ক্ষমাপ্রাপ্তির জন্য আমরা জানতাম যে আমাদের বিশ্বাসের তীর্থযাত্রী হতে হবে, আর এটি ছিল সবার জন্য এক অনন্য মুহূর্ত এবং আমরা চেয়েছিলাম এটি হোক আমাদের তীর্থযাত্রার শীর্ষবিন্দু।” পবিত্র স্থানসমূহ পরিদর্শন, পবিত্র দরজা অতিক্রম, পবিত্র খ্রিস্টযাগ উদযাপন, কমিউনিয়ন গ্রহণ, পোপের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা, নিজের পাপস্বীকার এবং আমাদের দল হিসেবে পূর্ণতার পথে একটি সৎকর্ম সম্পাদন করতে আমরা সকলে তা করেছি। অথৈ ঘোষের অভিজ্ঞতায়, “২০২৫ বছর পূর্তিতে চারটি পবিত্র দরজা অতিক্রম করা ছিল এক অনন্য সুযোগ, আর এই আলোকোজ্জ্বল শহরে পাপস্বীকারের অভিজ্ঞতা আমার জুবিলীর পথকে আরও সম্পূর্ণ করেছে।”

২ আগস্ট পোপ চতুর্দশ লিও’র সাথে যুবাদের নিশি জাগরণী প্রার্থনা ও ধর্মশিক্ষা

শনিবার, ২ আগস্ট, সকাল-বিকাল ছিল ত্যার ভেরগাতায় যাত্রার সময়। যুবারা দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে রোম শহরের একপ্রান্তে তের ভেরগাতে (ভাটিকান সিটি থেকে ২৯ কিলোমিটার) দূরে পৌঁছায়। বিকালের মধ্যে স্থানটি যেন যুবাসমুদ্রে পরিণত হয়ে যায়। প্রচুর গরম থাকা সত্ত্বেও গান করতে করতে ও বিশ্বাসের সাক্ষ্য দিতে দিতে যুবারা পৌঁছে যায় তের ভেরগাতাতে। সন্ধ্যায় শুরু হয় আরাধনা, শাস্ত্রপাঠ ও ধর্মশিক্ষা। পথের সকল ক্লান্তি, কষ্ট ও অপেক্ষার পর দিনের শেষে সেই সব কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম যখন ঘোষণা করা হলো যে পোপ লিও যুবাদের মাঝে এসে পৌঁচ্ছেছেন। সারা থিগিদি’র অনুভবে, “পোপের আগমন সংবাদ শুনে আমাদের হৃদয় উত্তেজনায় ভরে ওঠলো। পোপকে যখন কাছ দিয়ে যেতে দেখলাম, মনে হলো সব কষ্টই সার্থক হয়েছে, হৃদয়ে এমন এক শান্তি অনুভব করছিলাম।”

সারা দিনের প্রচণ্ড রোদ ও তারাভরা রাতে খোলা আকাশের নীচে লাখো যুবাদের সাথে থাকার অভিজ্ঞতায় পার্থ বাড়ৈ বলেন, “কেবল ঈশ্বরের কাছে থাকার আকাঙ্খা এবং ভালোবাসায় পূর্ণ একটি হৃদয়ই পারে হাঁটার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে ও দিনের রোদে কাটানো ঘণ্টার পর ঘন্টা।” পাথিয়া চিসিম বলেন, “পোপের বেদী মঞ্চে উপস্থিতির পর ‘সিস্’ এই শব্দটায় ছিল প্রায় দশ লক্ষ যুবাদের মাঝে মহানীরবতার আহ্বান। আর প্রার্থনায় জাগ্রত রাত ছিল ঈশ্বরের সেই মহান উপহারকে আমার হৃদয়ে উপলব্ধি করতে পারার এক বিশেষ মুহূর্ত ।

সেই রাতে আমরা সবাই পোপ লিও এবং বিশ্বজুড়ে প্রায় দশ লক্ষাধিক তরুণের সঙ্গে গভীর প্রার্থনায় সংযোগ ছিলাম। এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা! নীরবতা, আধ্যাত্মিক গভীরতা ও শ্রবণের পরিবেশে মেক্সিকো, ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন তরুণ পোপ লিওকে প্রশ্ন করেছিল প্রকৃত বন্ধুত্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল্য এবং ভালো ও সত্যের আকাঙ্খা নিয়ে। প্রশ্নোত্তর পর্বে পোপ মহোদয় ৩ জন যুবক-যুবতী যারা যথাক্রমে স্পেনিস, ইতালিয়ান ও ইংরেজি ভাষাভাষীর মানুষ তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন।

মেক্সিকোর ২৩ বছর বয়সী দুলচে মারীয়া অনলাইন বা ইন্টারনেটের অস্থায়ী ও মায়াময় বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এনে প্রথম প্রশ্নে বলেন, “আমরা কীভাবে প্রকৃত বন্ধুত্ব ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা খুঁজে পেতে পারি, যা আমাদেরকে সত্যিকারের আশার পথে নিয়ে যাবে?” উত্তরে পুণ্যপিতা বলেন, যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদেরকে সংলাপের অপূর্ব সুযোগ দান করে তথাপি এটি আমাদেরকে ভোগবাদে আসক্ত করে রাখতে পারে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, প্রকৃত বন্ধুত্ব তখনই স্থায়ী হতে পারে যখন তা ঈশ্বরের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।

গায়া নামে ১৯ বছরের এক ইতালিয়ান মেয়ে দ্বিতীয় জিজ্ঞাসায় জানতে চায় সেই অনিশ্চয়তার পরিবেশ সম্পর্কে; যা অনেক তরুণ-তরুণীকে অচল করে দেয় এবং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বাঁধা সৃষ্টি করে। উত্তরে পোপ লিও জোর দিয়ে বলেন, এই সিদ্ধান্তগুলো কোন কিছু বেছে নেওয়ার ব্যাপার নয়, কিন্তু কাউকে বেছে নেওয়ার বিষয়। যখন আমরা সিদ্ধান্ত নেই, তখন আমরা ঠিক করি ‘আমরা কী ধরণের মানুষ হতে চাই’। শেষ প্রশ্নটি করেছিল, ২০ বছর বয়সী আমেরিকান যুবক উইল। সে জিজ্ঞাসা করে, “আমরা কীভাবে যিশুর সাথে সত্যিকার সাক্ষাৎ করতে পারি এবং কীভাবে নিশ্চিত হতে পারি পরীক্ষা ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও তিনি আমাদের সাথে আছেন?” এর উত্তরে পুণ্যপিতা জোর দিয়ে বলেন, তোমরা জীবনের পথ নিয়ে ভাবতে, ন্যায়বিচার খুঁজতে, দরিদ্রদের সেবা এবং পবিত্র সাক্রামেন্তে খ্রিস্টকে আরাধনা করে যিশুর সাক্ষাৎ পেতে পারো।

আমাদের দলের কাছে সবচেয়ে প্রত্যাশিত উত্তর ছিল বন্ধুত্ব নিয়ে, যেখানে পোপ লিও বলেছিলেন যে “মানবিক সম্পর্ক অপরিহার্য এবং কেবল সততা ও স্থায়ী বন্ধনই ভালো জীবনের গল্প তৈরি করে।” তিনি সাধু আগষ্টিনকে উদ্ধৃত করে বলেন, “যে বন্ধুত্ব বিশ্বস্ত নয় তা কখনোই খ্রিস্টেতে নয়।” তিনটি প্রশ্নের শেষে পোপ লিও তরুণদের ন্যায় ও আশার সাক্ষী হতে আহ্বান জানান। ফাদার জেমস শ্যামল গমেজ তার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, “নিশি জাগরণ প্রার্থনা ছিল খুব গভীর। দিনের রোদ এবং রাতের বৃষ্টির কষ্ট সত্ত্বেও আমরা সবাই একই নৌকায় যিশুর ভালোবাসায় সুরক্ষিত ছিলাম। সবসময় নিশ্চিত ছিলাম যে আমরা সঠিক জায়গায় আছি এবং সবকিছু ভালোই হবে।”

সবাই উল্লেখ করেছেন সেই নীরবতা ও যিশুর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময়ের কথা। যেখানে প্রভুর পবিত্র রূপের (আরাধ্য সংস্কারের) সামনে হাঁটু গেড়ে, পোপ লিওর সাথে একাত্ম হয়ে সব কিছুর জন্য প্রত্যেকে ধন্যবাদ দিয়েছে প্রভুকে। প্রত্যেকেই ব্যক্তিগতভাবে রোজারীমালা প্রার্থনার মাধ্যমে নিজেদের আবেদনসহ অনেক মানুষের উদ্দেশ্য মা মারীয়ার দ্বারা তুলে ধরেছেন পিতার চরণে। সিস্টার মেরী অন্তরা, এসএমআরএ বলেন, “প্রার্থনার যে একটা নিরাময় শক্তি আছে, আমি তা নিশি জাগরণী প্রার্থনায় অনুভব করেছি। হাঁটতে হাঁটতে আমার পাগুলো প্রায় ব্যাথায় অবশ হয়ে গেছে, শরীর খুবই ক্লান্ত ছিল, বসতে পারিনি, রোজারী প্রার্থনা করার কিছুক্ষণ পরই অনুভব করলাম আমার সব কষ্ট, যন্ত্রণা, ব্যাথা, ক্লান্তি যেন নিমেষেই দূর হয়ে গেছে।”

দুঃখের বিষয় হলো, এ যুব জুবিলী তীর্থে স্পেনের মারীয়া ও মিশরের পাস্কেল নামে দু’জন যুবতী মারা গেলে পুণ্যপিতা তাদের ও তাদের পরিবারের জন্য প্রার্থনা করতে সকলকে আহ্বান করেন। পোপ লিও যুব জুবিলী উৎসবে উপস্থিত যুবদেরকে আশা ও শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে আহ্বান করেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা ও ইউক্রেনের যুবক-যুবতীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে তাদেরকে বিশ্বে পরিবর্তন আনতে উৎসাহিত করেন।

৩ আগষ্ট ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, যুব জবিলী উৎসবের মহাখ্রিষ্টযাগ
সূর্যোদয়ের সঙ্গে নতুন দিন, রবিবার প্রভুর দিন। যদিও এই যুব জুবিলীতে অফিসিয়াল নিবন্ধন পাঁচ লাখের কিছু বেশি, তবুও সমাপনী খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণকারী ছিল ১০ লক্ষ বিশ্বাসী মানুষ। পুণ্যপিতা লিও মহাখ্রিস্টযাগ অর্পণ করেন। এছাড়াও ৪৫০জন বিশপ ও ৭ হাজার যাজক এই বিশেষ খ্রিস্টযাগে উপস্থিত ছিলেন। সমাপনী খ্রিস্টযাগে পোপ লিও তরুণ ও মণ্ডলীর জন্য বহু চ্যালেঞ্জ রেখে যান। তার মধ্যে তিনটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: তরুণদের তিনি আমন্ত্রণ জানান তাদের অন্তরের তৃষ্ণাকে ভয় না পেতে, বরং ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাতের সোপান হিসেবে তা ব্যবহার করতে: “এই তৃষ্ণাকে আমরা যেন মিথ্যা বিকল্প দিয়ে প্রতারিত না করি”; পোপ তাঁর উপদেশের সমাপ্তিতে তরুণদের আশায় বিশ্বাস রাখতে আহ্বান জানান, কারণ তা প্রতারণা করে না “ঈশ্বরের ভালোবাসা আমাদের হৃদয়ে ঢেলে দিয়েছেন পবিত্র আত্মা”, এবং তিনি তরুণদের উৎসাহিত করেন “আনন্দের সঙ্গে চলতে, তাদের বিশ্বাসের সাক্ষী হতে এবং আশায় বিশ্বকে স্পর্শ করতে।”

যুব জুবিলীর শেষে দূত সংবাদ প্রার্থনার পর পোপ লিও প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসের ২ বছর আগে লিসবনে দেওয়া ঘোষণার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, আগস্ট ৩ থেকে ৮, ২০২৭ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ব যুব দিবসে দেখা হবে সিওল, কোরিয়াতে। যেমনভাবে পোপ ত্যার ভেরগাতায় “পোপাহেলি”তে করে এসেছিলেন, তেমনভাবেই তিনি যুব জুবিলী’র সমাপ্ত ঘোষণা করে বিদায় নিলেন এবং প্রতিশ্রুতি জোরালো করলেন যে আমরা সবাই খ্রিস্টের সঙ্গে তীর্থযাত্রী হয়ে চলব। সর্বদা!

৪ আগষ্ট ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ পাদুয়ায় সাধু আন্তনীর মহামন্দির ও ঐতিহ্যের শহর ভেনিস পরিদর্শন

সারা রাত যাত্রা করে আমরা সকাল ৬:৩৫ মিনিটে পৌঁচ্ছে যাই পাদুয়া শহরের সাধু আন্তনীর মহামন্দির চত্বরে। প্রেরিতগণের রাণী মা মারীয়ার কয়েক জন সিস্টার আমাদের স্বাগতম জানান এবং সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করেন। মন্দিরের ভিতরে বিশেষভাবে সংরক্ষিত করে রাখা সাধু আন্তুনীর কবর, তাঁর বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন পরিদর্শন ও প্রার্থনা করা হয়। পূর্বেই নির্ধারিত সময়ে মন্দিরের ভিতরে সকাল ৯:০০টায় পবিত্র খ্রিস্টযাগ অর্পণ করেন এপিসকপাল যুব কমিশনের সেক্রেটারী ফাদার বিকাশ জেমস রিবেরু, সিএসসি ও উপদেশ প্রদান করেন ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশীয় যুব সমন্বয়কারী ফাদার প্রলয় আগষ্টিন ক্রুশ। একই সাথে আরো ৫জন যুব সমন্বয়কারী যাজক সহার্পিত খ্রিস্টযাগে ছিলেন।

সাধু আন্তুনীর প্রতি ভক্তি-ভালাবাসা প্রদর্শনের পর আমরা যাত্রা করি ভেনিসের উদ্দেশ্যে। দুপুরের দিকে পৌঁচ্ছে দেখি নীল সমুদ্রের লোনা পানির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ছোট একটি শহর-ভেনিস। দেখে মনে হচ্ছে পানির উপরে হাওয়ায় যেন ভেসে আছে শহরটি এবং হঠাৎ করেই জোরে আসা কোন ঢেউয়ের আঘাতে হয়তো চলে যাবে অন্য কোন প্রান্তে। এটি ইউরোপের এমন একটি শহর যেখানে আপনাকে যাতায়াত করতে হবে হেঁটে কিংবা নৌকার মাধ্যমে।

দুপুরের খাবার শেষে আমরা ফাদারদের তত্ত্বাবধানে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নৌকাযোগে শহরের দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক দৃশ্য ও ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরা বাড়িগুলোর অনিন্দ সৌর্ন্দয উপভোগ করি। চাইলেই আমরা কোন গাড়ি, ট্রেনে বা বাসে চলাচল করতে পারবো না। কারণ এ রকম কোন ব্যবস্থা এখানে নেই তাই কোন কালো ধোঁয়াও নেই। অন্যান্য আধুনিক বড় শহরের মতো পরিবেশ দূষণের দেখা পাইনি ভেনিসে। প্রাকৃতিক সৌর্ন্দযে ভরপুর ও পরিবেশ দূষণমুক্ত শহর হওয়ায় ভেনিস শহরটি গল্পে নয়; সত্যিই আমাদের সকলেরই কাছে আকর্ষণীয় ছিল।

পরিশেষে, আধ্যাত্মিক উন্নতি, পাপমোচন, এতিহ্য সংরক্ষণ, বিশ্বাসে পুনর্নবীকরণ, মিলন এবং আনন্দের গভীর তাৎপর্য অনুভব করা, ঈশ্বরকে দয়া-দানের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা, সামাজিক সংযোগ বৃদ্ধিকরণ, ঈশ্বর ও ধর্মবোধের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা বাড়ানো। ঈশ্বরের সঙ্গে সংযাগ স্থাপন এবং মানসিক ও আত্মিক পূর্ণতা, প্রতিবেশী ভাইবোনদের সাথে মিলন, আশা, ন্যায্যতার আচরণ, দেশ, সমাজ ও স্থানীয় ম-লীর জন্য নিবেদিতভাবে সেবাপ্রদান, সর্বোপরি যুব জীবনে চেতনার নবায়ন, মিশনারী হয়ে প্রচারকাজের অনুপ্রেরণা ও খ্রিস্টিয় জীবনে জাগরণ নিয়ে আমরা দেশে প্রত্যাবর্তন করি।

Please follow and like us: