করোনা ভাইরাসে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। প্রায় দেড় বছর যাবৎ করোনা ভাইরাসের কাছে মানুষ পরাজয় বরণ করে আসছে। মৃত্যুর মিছিল দিনকে দিন বাড়ছে। যদিও ইউরোপ মহাদেশ করোনা পরিস্থিতি প্রায়ই শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে কিন্তু করোনার ঢেউ বয়ে যাচ্ছে এশিয়া মহাদেশের উপর দিয়ে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ভারতের পর এবার বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। যদিওবা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে; অনেককে ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে তবু বলা চলে তা অপ্রতুল। আর কার্যকারীতা কতটুকু তাও প্রশ্নবিদ্ধ! ভ্যাকসিন নিয়ে ইতোমধ্যে বৈশ্বিক রাজনীতি শুরু হয়েছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, তবে কি ভ্যাকসিনের বাজার ধরার জন্য কোন দেশের গোপন অভিসন্ধির ফল এই করোনা ভাইরাস! তবে সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে মানুষের পাপের ফল হচ্ছে এই করোনা ভাইরাস। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রতি একশত বছর পর পর মানব জাতির মধ্যে বিপর্যয় দেখা দেয়। আর মহামারি বা ভাইরাসই মানুষকে গত কয়েক শতক ধরে নাস্তাবুদ করে ছাড়ছে। তবে করোনা ভাইরাসের মতো এমন মারাত্মক ভাইরাসের আবির্ভাব এই প্রথম বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে প্রবক্তা নোয়ার সময়ে মানবজাতির ধ্বংসের পর বর্তমান সময়ে করোনা ভাইরাস মানুষের জীবনের গতি পাল্টে দিচ্ছে। নোয়ার সময় ঈশ্বর বিশ্বাসী ও নৈতিকতাপূর্ণ নোয়ার পরিবারই বেঁচে ছিলো মাত্র। আর অন্যান্য মানুষ ও জীবজন্তু মারা যায়। প্লাবনের পর আবার মানব জাতির পথচলা শুরু হয়েছে। প্রবক্তা নোয়া প্লাবনের পর পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। “তারপর প্রভুর উদ্দেশ্যে বেদী তৈরী করে শূচিশুদ্ধ পশু ও পাখি যজ্ঞবলি হিসাবে নিবেদন করেন” (আদিপুস্তক ৮:২০)। প্রবক্তা নোয়ার মধ্যে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ছিলো খাঁটি এবং বিশ্বস্থতায় ভরা। ঈশ্বর যেহেতু তাকে রক্ষা করেছেন তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা অবশ্যই কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। প্রবক্তা নোয়া আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। প্রতিদিন ঈশ্বরের নিকট থেকে আমরা কত শত অনুগ্রহ পেয়ে যাচ্ছি কিন্তু কখনো কৃতজ্ঞ হয়েছি কিনা সেটা মনে পড়ে না। নিজের পাওয়া না পাওয়া নিয়ে কত ব্যতিব্যস্থ কিন্তু ঈশ্বরের প্রয়োজনটুকুর খোঁজ কখনো নিই না। তবে আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া না হওয়ার মধ্যে ঈশ্বরের কোন যায় আসে না তবে কৃতজ্ঞতা ঈশ্বরের প্রতি আমাদের ভিতর থেকে আসা প্রয়োজন।
পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই কৃতজ্ঞতাবোধ রয়েছে। তবে প্রকাশভঙ্গি ও ভাষা একেক রকম। অবলা প্রাণী মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লেজ নাড়িয়ে বা নানান রকম অঙ্গভঙ্গি করে। তবে মানুষই এর ব্যতিক্রম। একেক মানুষ একেক পরিস্থিতিতে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। মানুষ মানুষের প্রতি বিনিময় বা মৌখিক শব্দ প্রয়োগ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে। আবার অন্যদিকে মুখের হাসি বা তাকানোর ভঙ্গিমাই বলে দেয় ব্যক্তির কৃতজ্ঞতা কতটুকু শুদ্ধ ও খাঁটি। এর বিপরীত ধারার ব্যক্তির অভাবও কম নয়। অনেকেই আছেন যারা শুধু পাওয়াতেই আনন্দ খুঁজে পায়। বিনিময়ে কৃতজ্ঞতা নামক মহত্ত¡ম প্রকাশের টিকিটিও তাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন ব্যক্তিরা অকৃতজ্ঞই থেকে যায় সব সময়। তারা যেমন মানুষকে কৃতজ্ঞতা জানায় না তেমনি সৃষ্টিকর্তা যিনি সব কিছু দিয়েছেন তাঁকেও কৃতজ্ঞতা জানাতে কুণ্ঠাবোধ করে। এই ধারার মানুষগুলো মনে করে যে অন্যদের সাহায্য পাওয়াটা তার অধিকার এবং সেজন্য ওই ব্যক্তিকে ধন্যবাদ দেওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না।
২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ক্যাথলিক মণ্ডলিতে ‘দয়ার বর্ষ’ পালন করা হয়েছে। ঈশ্বরের নিকট থেকে আমরা প্রতিনিয়ত যে দয়া-অনুগ্রহ পেয়ে থাকি তার জন্য ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। চিন্তা করলে দেখি জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কতশত দয়া-অনুগ্রহ আমরা ঈশ্বরের কাছ থেকে পাই; কিন্তু বিনিময়ে কৃতজ্ঞতার অঞ্জলি কতটুকু ঝরে পড়ে তা প্রশ্নবিদ্ধ! এমন হয়- আমরা কৃতজ্ঞতার বহির্প্রকাশ প্রার্থনা করতে করতে ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে পড়ি কিন্তু যে ঈশ্বর আমাদের প্রদান করেন তিনি আমাদের প্রার্থনা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হন না। কি অসামঞ্জস্য সষ্ট্রা আর সৃষ্টিতে! তবু আমরা পাওয়ার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেতে ক্লান্ত হই না। ভুলে যাই ঈশ্বরের দেওয়া জীবনের কথা আর যখন ভুলে যাই তখনই ঈশ্বরের সাহচর্য থেকে আলগোছে সরে যাই দূরে। অভিভাবকহীন দিক্বিদিক হয়ে ঘুরতে থাকি। জীবনের যে একটি অর্থ আছে তা হারিয়ে ফেলি। ঈশ্বর যে জীবন দিয়েছেন তা আর উপলব্ধিতেই আসে না।
ঈশ্বর যে আমাদের জীবন ও জগৎ দিয়েছেন তা স্বীয় সত্ত্বায় প্রবেশ করাতে পারলেই ঈশ্বরের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার ডালি প্রকাশিত হয়। ঈশ্বর তো বেশী কিছু চান না; বরং চান মানুষ যেন কৃতজ্ঞ থাকে। খ্রিস্টধর্মীয় শিক্ষা ‘ঈশ্বর মানুষকে কেন সৃষ্টি করেছেন’ বাক্যের মধ্যেই ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি চিহ্ন রয়েছে; “ঈশ্বরকে জানতে, মানতে, ভালবাসতে ও ঈশ্বরের সাথে স্বর্গে চিরশান্তিতে থাকতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন”। ঈশ্বরকে জানা ও মানার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নিহিত আর এর ফলে ঈশ্বরের যে মহত্তমতা ও মানুষের প্রতি ভালবাসার ফল তা স্বর্গে চিরকালের জন্য মানুষকে বসবাসের সুযোগ প্রদানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। ঈশ্বরের সাথে এটা কোন ব্যবসায়িক বা বিনিময় সম্পর্ক নয় বরং এই সম্পর্ক উচ্ছ্বসিত হৃদয় হতে উদ্ভাসিত। বর্তমান বিশ্ব খুবই দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে মানুষের বিশ্বাস, আচার-আচরণ, ধ্যান-ধারণা ও সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা। আর এরই মাঝে ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে জীবন অতিবাহিত করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ। মানুষ আধুনিকতার সংস্পর্শে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করতে ভুলে যাচ্ছে। এরই মাঝে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকাটা আসলেই হুমকীর মুখে! তবু ঈশ্বর নিজেকে নানাভাবে প্রতিনিয়ত প্রকাশ করছেন; কারণ ঈশ্বর স্থিতিশীল নন বরং সময়ের সাথে আদি ও অনন্ত। তাই নানাবিধ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের উপস্থিতির প্রকাশ স্পষ্টতর হয়ে উঠে।
যুক্তিবিদ্যার ভাষায় প্রত্যেকটি ঘটনার কারণ থাকে। আবার বিজ্ঞানের ভাষায় প্রতিটি ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তেমনি এই পৃথিবীতে মানুষের জন্মের নিশ্চয় কারণ রয়েছে। কারণ মানুষের জন্ম যেমন একটি ঘটনা তেমনি এটি একটি ক্রিয়াও বটে। আর ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন কারণবিহীন নয়। ইতোমধ্যে খ্রিস্টধর্মীয় শিক্ষার আলোকে মানুষ সৃষ্টির রহস্য বলা হয়েছে। দীক্ষাস্নানের গুণে আমরা সবাই দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হয়ে উঠার আহ্বান লাভ করেছি। সেবক হয়ে উঠার বাহ্যিক রূপ হচ্ছে আমরা মানুষের কাছে প্রেরিত ঐশ্যরাজ্যের সুসংবাদ পৌঁচ্ছে দেবার লক্ষ্যে। সেবক হয়ে উঠার অর্থ এই নয় যে, ক্ষমতা নিয়ে বসে থাকা বরং সেবক হয়ে উঠার মধ্য দিয়ে একজন সেবক নিজের আমিত্বকেই বিসর্জন দেয় ও কৃতজ্ঞতার অঞ্জলি ঈশ্বর ও মানুষের চরণেই নিবেদন করেন। যাই হোক- রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের আজকের যে সৌন্দর্যশোভা বাহ্যিকভাবে দেখা যায় তার পেছনে অগণিত বিশ্বস্ত সেবকের আত্মত্যাগ ও কর্মযজ্ঞের মিশেল সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। ঈশ্বরের রাজ্যের রূপ পরিগ্রহ হচ্ছে খ্রিস্টিয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার আলোকে। তাই রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের সকল শ্রেণীর খ্রিস্টভক্তবিশ্বাসী ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ।
যিনি কৃতজ্ঞ নন তিনি অকৃতজ্ঞ; আর কৃতজ্ঞতা শুধু মুখের কথায় প্রকাশ পায় না বরং বাহ্যিকতায় কাজে প্রকাশিত হয়। যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক তাকে সব সময় কৃতজ্ঞতা ভরা অন্তর নিয়ে চলতে হয়। কারণ যিনি দায়িত্ব পান তিনি অন্য ব্যক্তির চেয়ে আলাদা। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ঈশ্বর কৃর্তক ব্যক্তি, সমাজ, দল ও গোষ্ঠি কর্তৃকও নিযুক্ত হন। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিজের সুবিধা, পদ, সন্মান ও ক্ষমতা দেখেন না বরং তিনি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ, মণ্ডলি তথা সমগ্র বিশ্বের প্রাণীকুলের মঙ্গলের জন্য নিজের সময়, শ্রম, মেধা, অর্থ ও দেহকে দান করেন। যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত তাকে সেবকের মনোভাব নিয়ে পরিচালনা করতে হয়, “যে বড় হতে চায় তাকে করা হবে ছোট, আর যে ছোট তাকে করা হবে বড়”। একজন সত্যিকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবকের মনোভাব তেমনটিই হতে হয়। খ্রিস্টবিশ্বাসী আমরা প্রত্যেকে যিশুর মতো কষ্টভোগী সেবক; কষ্টকে ধারণ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হয়ে উঠা যায়। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হয়ে উঠার সুযোগ এসেছে। ইতোমধ্যে অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে নিজেদের জীবনকে অন্যের সেবায় উৎসর্গ করছেন। করোনা ভাইরাস মানুষকে দায়িত্বপ্রাপ্ত করে গড়ে তুলছে। এ বছরে করোনা পরিস্থিতিতে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পালকীয় কর্মশালার মূলভাব “দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবকের আহ্বান: ‘কৃতজ্ঞ হও’ যুগোপযোগী। দীক্ষার গুণে মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে যে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে তা যথাযথ ব্যবহার করে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞা প্রকাশ করা দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবকের আহ্বান।
– ফাদার সাগর কোড়াইয়া