ফা: দিলীপ এস.কস্তা

যিশুর অনেক পরিচয়ের মধ্যে তিনি হলেন উত্তম মেষপালক। তিনি নিজেই তা বলেন, “আমি প্রকৃত মেষপালক। প্রকৃত মেষগুলির জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়” (যোহন ১০:১১)। জীবন উৎসর্গ বিসর্জন দেবার মাধ্যমে অনেক বিশ্বাসী ভক্ত সেবক উত্তম মেষপালকের সাক্ষ্য দিয়েছেন। যিশুর প্রতি গভীর ভালবাসা ও জীবন-উৎসর্গের ব্রতেই একজন বিশ্বাসী ভক্ত সেবক উত্তম মেষপালক হয়ে উঠে। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সসহ ইউরোপের অনেক দেশেই ধর্মের ভিত কিছুটা হলেও নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ধর্মীয় জীবনের এই নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেই ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠে বিশ্বাসী যুবক। যার মেধা-মননের চাইতে বিশ্বাস-ভালবাসা ও আত্মত্যাগ ছিল জীবন গঠনের বড় হাতিয়ার। তিনি হলেন আর্চ নগরের যোহন বাপ্তিস্তা মারীয়া ভিয়ান্নী। কঠোর কৃচ্ছতা ও সাধনার পথ ধরে আধ্যাত্মিক চেতনার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আশাহত, ভগ্নহৃদয় ও তমস্যায় আচ্ছন্ন মানুষের হৃদয়ের নব বিশ্বাসের প্রদীপ জেলেছেন।

শৈশব-বাল্যকাল ও ঐশ আহ্বান
যুগে যুগে ঈশ্বর তাঁর মহিমা ও প্রশংসার জন্য বেছে নেন অতি ক্ষুদ্র, নগণ্য ব্যক্তিকে। জন মেরী ভিয়ান্নী তাদেরই একজন। যাজকীয় অধ্যয়নে তিনি ছিলেন অতি দূর্বল, অন্যান্য বিষয়গুলো কোনমতে পাশ করলেও ল্যাটিনে বরাবরই আটকে যেতেন। তাই তার সেমিনারীর পরিচালকগণ তাকে যাজকীয় পদে অভিষেক দিতে সম্মতি দেননি। লিয়ন ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেলের সমর্থনে তিনি যাজক পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। তাঁর জন্ম ৮ই মে, ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স দেশের লিয়ন ধর্মপ্রদেশের ডারলিন গ্রামে। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান হওয়ায় তিনি কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বিশেষভাবে মেষ ও শষ্য উৎপাদন কাজে তিনি তার পিতাকে সাহায্য করতেন। তাই একটু বেশী বয়সে পড়াশুনা শুরু করতে হয়েছিল। ১৪ বৎসর বয়সে তিনি প্রথম যাজক হওয়ার জন্য সেমিনারীতে প্রবেশ করেন এবং ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি যাজক পদে অভিষিক্ত হন। অভিষেকের ৩ বছর পর ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে তার বিশপ তাকে আর্চ নগরের পালক পুরোহিত নিযুক্ত করেন। ২৩০ জন খ্রিস্টভক্তের অবহেলিত অজপাড়া গায়ের এই ধর্মপল্লীতে তিনি ৪১ বছর পালকীয় সেবা কাজে নিজেকে বিলিয়ে দেন। ১৮৫০খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা আগষ্ট তিনি আর্চ নগরেই মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ২৬শে জুলাই পোপ ত্রয়োদশ লিও তাকে Venerable বা পূজনীয় পদে শ্রেণীভুক্ত করেন এবং ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারী তাঁকে ধন্যশ্রেণীভুক্ত করা হয়। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে মে পোপ একাদশ পিউস তাঁকে সাধু শ্রেণীভুক্ত করেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের পোপ একাদশ পিউস তাঁর সরলতা, ধার্মিকতা ও উত্তম পালকের দৃষ্টান্তের কথা স্মরণ করে সকল পালক পুরোহিত তথা: ধর্মপ্রদেশীয় যাজকদের প্রতিপালক হিসাবে ঘোষণা দেন। তারই জীবনাদর্শে ও আধ্যাত্মিকতাকে অনুসরণ, অনুকরণ করার লক্ষ্যে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট এই বছর (১৯শে জুন ২০০৯ – ১৯শে জুন ২০১০) যাজক বর্ষ হিসাবে ঘোষণা দেন জন মেরী ভিয়ান্নীর ১৫০ মৃত্যু বার্ষিকীতে। যাজক বর্ষ যেন সুসম্পর্ক বাড়ে এবং যাজকগণ যেন যাজকীয় জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বিশ্বস্ত হতে পারে। জন মেরী ভিয়ান্নী ৪১ বৎসরের পালকীয় জীবনে তিনি বহু মানুষের মন-পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন এবং আধ্যাত্মিক নিরাময় ও সুস্থতা দান করেন। অতি সাদামাটা জীবন-যাপনের তিনি স্থান দিয়েছিলেন প্রার্থনা, উপবাস, ত্যাগস্বীকার ও কৃচ্ছতা সাধনাকে।

সাধু জন মেরী ভিয়ান্নীর পালকীয় জীবনের কয়েকটি দিক

আর্চ নগরে ছোট্ট ধর্মপল্লীতে তাঁর আগমনের সময় খ্রিস্টভক্তদের কোন উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। ধূলায় বিবর্ণ যাজক ভবন তখন পোকা মাকড়ের ঘর বসতি। সেখানেই তিনি ঠাই করে নিলেন তাঁর বসতি। পালকীয় কাজের শুরুতে তিনি তিনটি বিষয়ে লক্ষ্য করলেন যা খ্রিস্টভক্তদের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জীবনের অবক্ষয় আনতে সহায়ক ছিলো। আর তা হলো-
(ক) অত্যধিক মদ্যপান ও মাতাল লোকের আধিক্য
(খ) মেলা ও নাচের উৎসবে পানাহার (বিশেষভাবে গ্রীষ্মকালে ও ফসল কাটার উৎসব)
(গ) গীর্জায় খ্রিস্টভক্তদের অনুপস্থিতি ও কাটেখিজম শিক্ষার অভাব

ধর্মপল্লীর এই বাস্তবতার পরিবর্তনের জন্য তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ধ্যান-প্রার্থনা, উপবাস ও ত্যাগস্বীকার করতে আরম্ভ করলেন। কঠোর কৃচ্ছতা ও উপবাসের সাথে সাথে পালকীয় কাজ, পরিবার পরিদর্শন, কাটেখিজম শিক্ষা ও রোগীদের প্রতি বিশেষ যত্ন দিতে শুরু করলেন। অল্প দিনের মধ্যে তিনি ধর্মপল্লীর সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন এবং অনেকেই গীর্জায় আসতে শুরু করলেন। পালকীয় কাজের জন্য তিনি কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন-
(ক) মদপান ও মাতাল অবস্থা থেকে লোকদের ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যক্তিগত সাক্ষাত ও যোগাযোগ করতেন।
(খ) স্থানীয় মানুষের সহায়তায় নাচের উৎসব বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন।
(গ) পরিবার পরিদর্শনের মাধ্যমে লোকদের গীর্জামুখী হতে অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দেওয়া।
(ঘ) শ্রেণীভেদে কাটিখিজম শিক্ষাদান করা (বিশেষভাবে ছেলে-মেয়েদের পাপস্বীকার ও হস্তার্পণ সংস্কার গ্রহণের পূর্বে কাটিখিজম শিক্ষা দিতেন)।

সাধু জন মেরী ভিয়ান্নীর অতি সাদা-মাঠা জীবন-যাপন করার মধ্য দিয়ে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর জীবন দৃষ্টান্ত ও উপদেশের মাধ্যমে আর্চ নগরী তথা গোটা মণ্ডলির মানুষের আধ্যাত্মিক নিরাময়ের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।

Please follow and like us: