জন-জীবনের কথা
ফাদার সাগর কোড়াইয়া
ফাদার লেনার্ড রোজারিও’র সাথে তেমন একটা পরিচয় ছিলো না। তবে তার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছে বেশ কয়েকবার। কথা হয়েছে; একসাথে খাওয়া-দাওয়াও করেছি। ফাদার লেনার্ডকে প্রথম দেখি রমনা সেমিনারীতে থাকাকালীন। তখন তিনি সম্ভবত মাউসাইদ ধর্মপল্লীতে কর্মরত। একদিন সেমিনারীতে মঙ্গলবারে সন্ধ্যাকালীন খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করতে এসেছিলেন। শ্মশ্রুমণ্ডিত চেহারার মধ্যে সাধু পুরুষ ভাব রয়েছে। পাঞ্জাবী পরিহিত অবস্থায় দেখেছিলাম। রবি ঠাকুরের সাথে তুলনা করা অত্যুক্তি হবে তবু বলি দেখতে রবীন্দ্রনাথের মতো মনে হতো কেন জানি। সাদা দাঁড়ির ফাঁক দিয়ে মুচকি হাসি সব সময় লেগেই থাকতো। ফাদার লেনার্ডের কথা বলার ধরণ দেখে ভেবেছিলাম কলকাতার ফাদার হবে হয়তো! পরে অবশ্য সে ভুল ভাঙ্গে। তিনি তো আমাদের দেশীয় ফাদারই। ফাদার লেনার্ডের স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণ সত্যি শিক্ষণীয়। সে সময় জানা ছিলো না ফাদার বাংলা খ্রিস্টিয় সঙ্গীতে একজন দক্ষ সঙ্গীতানুরাগী। ফাদারের রচিত অসংখ্য গান ও গানের সুরারোপ সত্যিই মনোমুগ্ধকর। নিঃসন্দেহে বলা যায়, ফাদার লেনার্ড তার গান ও সুরের সংযোজনের মধ্যে আলাদা একটা আধ্যাত্মিক ভাব ও গতি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। বাংলা ভাষাভাষী খ্রিস্টভক্তদের খ্রিস্টিয় বাংলা গানের সুরের যাদুতে ধরে রাখার শক্তি ছিলো ফাদার লেনার্ড রোজারিওর।
সেদিন সেমিনারীতে সন্ধ্যাকালীন খ্রিস্টযাগ শেষ হয়েছে; ফাদার লেনার্ড গানের দলের কাছে এসে হারমোনিয়ামটা টেনে নিলেন। বুঝতে পারলাম খ্রিস্টযাগে আমরা হয়তো কোন গান ভুল গেয়েছি। স্বর্গীয় ফাদার পৌল ডি’রোজারিও’র রচিত ও অরবিন্দ হীরার সুরোপিত ‘আমি নিজেকে উজাড় করে তাঁকে ভালবাসবো’ গানটি তিনি হারমোনিয়ামে উঠালেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। গানের কয়েকটি জায়গায় তিনি এমনই কাজ দিলেন যে গানের আসল সৌন্দর্যটা আপনি বেরিয়ে এলো। তিনি সাদা দাঁড়ির ফাঁক গলিয়ে মুচকি হেসে বললেন, এইভাবে গাইতে হয়! খ্রিস্টিয় সঙ্গীতে তিনি শুদ্ধ সুর ও উচ্চারণের উপর জোর দিতেন খুব। এবং এটাই হওয়া উচিত বলে মনে করতেন তিনি। ফাদার লেনার্ড রোজারিও’র বেশীর ভাগ গানই তিনি নিজে রচনা করে সুরারোপিত করেছেন। আর প্রত্যেকটি গানের কথা ও সুর অনন্য-অসাধারণ। যতদূর জানি- তার লেখা অনেক গান এখনো পর্যন্ত কোথাও প্রকাশিত হয়নি; সবার অগোচরেই রয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ মণ্ডলির সম্পদ ‘গীতাবলী’র ২২তম পরিমার্জিত ও পুনঃমুদ্রিতে ফাদার লেনার্ড রোজারিও’র ২৩টি গান স্থান পেয়েছে; যার বেশীর ভাগই তার নিজেরই রচিত ও সুরারোপিত। গানগুলো হচ্ছে- আমি পূজি হে তোমায়, উঠেছে ঘরে ঘরে নবজাতকের তরে, এসো নবীন বছর এসো এসো, ঐ ক্রুশ চরণতলে প্রভু মোর অন্তর দিলাম, খেজুর পাতা হাতে নিয়ে ইহুদীরা মহোল্লাসে, গাও গাও গাও গাও সবে জয়ধ্বনী গান, জয় জয় জয়! জয় প্রভুর জয় মুক্তিরাজের জয়, জয় স্বর্গেশ্বর জয় জয়দীশ্বর, জীবন দিয়েছে জীবননাথ বিশ্ব দিয়েছ বিশ্বনাথ, ধন্যবাদ প্রভু ধন্যবাদ, নব শতাব্দী নব সহস্রাব্দী নব জীবনের আহ্বান, পুণ্য পুণ্য প্রভু পরমেশ্বর, পৃথিবীর ইতিহাসে অবিরাম কালের প্রবাহে, প্রভু আমায় তুমি তোমার, প্রভু তুমি ব্যাকুল কণ্ঠে, প্রভু তোমার মরণ, মঙ্গলধ্বনী বাজে, মা বর্ষ বর্ষ ধরে সবাই, মৃত্যু বরণ করে প্রভু, শান্তি দাও প্রভু শান্তি, শোষণ শাসন অনাচার অবিচার ও হে করুণাময় পিতা ক্ষমা করো অপরাধ। এছাড়াও গীতাবলীতে এখনো পর্যন্ত স্থান পায়নি এমন দুটি গান জানি- অর্ঘ্য মোর, অর্ঘ মোর লও গো ঈশ্বর ও বাংলাদেশ ধর্মপ্রদেশীয় যাজক ভ্রাতৃসংঘের পঁচিশ বছরের জুবিলী বর্ষের মূল সংগীত ‘সহভাগিতা আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আমরা যাজক সমাজ’ গানটির সুর সংযোজন করেছেন ফাদার লেনার্ড রোজারিও ও রচনা করেছেন ফাদার দিলীপ এস. কস্তা। তবে পূর্বেই যাজকবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সিডি ক্যাসেটে গানটি সংরক্ষিত করা হয়েছে। এই গানটি সরাসরি ফাদার লেনার্ড রোজারিও’র নিকট থেকে শেখা। ফাদার লেনার্ড রোজারিও সুর করে রমনা সেমিনারীতে বসে আমাদের শিখিয়েছিলেন। গানটির সুর সত্যিই মনোমুগ্ধকর!
ফাদার লেনার্ডের যাজকীয় সেবাদায়িত্বের বেশীর ভাগ সময়ই কেঁটেছে ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশে। প্রত্যন্ত মান্দি এলাকায় ফাদারের রচিত ও সুরারোপিত উপাসনা সঙ্গীত মানুষের মুখে মুখে। শুধুমাত্র ময়মনসিংহ বললে ভুল হবে- সমগ্র বাংলাদেশের প্রত্যেকটি এলাকায়ই ফাদারের এই সৃষ্টিগুলো প্রাণবন্ত। একবার প্রৈরিতিক কাজে ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের একটি ধর্মপল্লীতে অবস্থানকালে গ্রামে গিয়েছি। গ্রামের খ্রিস্টভক্তগণ বাংলা উপাসনা সঙ্গীতে বেশ দক্ষ এবং শুদ্ধ সুর ও উচ্চারণ তাদের জানা। অবাক হলাম! জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারলাম- ফাদার লেনার্ড রোজারিও এই ধর্মপল্লীতে সেবাদায়িত্বে থাকাকালীন এই গ্রামে এসে গান শেখাতেন। গান ভুল করলে রাগ করতেন প্রচন্ড; চাইতেন গান যেন শুদ্ধভাবে গাওয়া হয়। তিনি বলতেন, ঈশ্বরকে যেটা দিবে সেটা যেন শুদ্ধই হয়। অপাতদৃষ্টিতে ফাদারের লেখা গানগুলোর কথা যদিওবা একটু কঠিন মনে হয় কিন্তু এর মধ্য দিয়ে খ্রিস্টের যে মহিমা ফুটে উঠে তা বুঝতে একদমই সহজ। ‘পৃথিবীর ইতিহাসে অবিরাম কালের প্রবাহে’ গানটি একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। গানটিতে তিনি খ্রিস্টের ঈশ্বরত্ত্ব প্রকৃতির মধ্য দিয়ে আদি থেকে অনন্ত পর্যন্ত আমাদের নিত্যদিনের কার্যক্রমে অসম্ভব সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
একবার পুণ্য সাপ্তাহে সহায়তা করার জন্য ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের ক্যাথিড্রালে ছিলাম। ফাদার লেনার্ড তখন অসুস্থ্য অবস্থায় সেখানে। প্রতিদিন খাবার টেবিলে দেখা হতো। তাকে দেখে কখনো বুঝতে পারতাম না তিনি অসুস্থ্য; হাসি-খুশি মনে খাবার খাচ্ছেন। আমার কেন জানি সে সময় মনে হতো ফাদারের মধ্যে সব সময় গানের যে সুর ছন্দায়িত হয় তা যেন তার নিত্যদিনের কার্যক্রম বিশেষভাবে খাওয়া-দাওয়ার মধ্যেও ছন্দায়িত হয়ে সুর সৃষ্টি হচ্ছে। গত মাসের ২০ তারিখে দুপুরবেলা তেজগাঁও ধর্মপল্লীতে ফাদারের সাথে দেখা। দিব্যি সুস্থ্য মনে হলো। গল্প করতে করতে খাবার ঘরে প্রবেশ করলাম। কোথায় আছি জিজ্ঞাসা করলেন। মথুরাপুর ধর্মপল্লী বলতেই বললেন, মথুরাপুর এক সময় ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের অধীনে ছিলো। অনেক আগে গিয়েছি। নিশ্চয় অনেক পরিবর্তন হয়েছে! ফাদার লেনার্ডের সাথে সেই শেষ দেখা। ফিরে আসার সময় নিমন্ত্রণ জানালাম। মুচকি হেসে মনে হলো সুরের আবেশে বললেন, শরীর আর চলে না।
‘শত সহস্র বছর ধরে বহিছে যে পরম সত্য’ সেই সত্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে সুরের যাদুকর ফাদার লেনার্ড রোজারিও আজ স্বর্গবাসী। ঈশ্বর এই সুরের যাদুকরের মাঝে যে সুর সংযোজন করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন সেই সুরের মূর্ছনায় বিমোহিত হয়েছে খ্রিস্টভক্তজনগণ। ফাদারের জীবনটাই যেন সুর হয়ে উঠেছিলো। নব নব সুর সৃষ্টিতে ব্যস্ত ছিলো ফাদারের সমগ্র জীবন। তবে নিজের মহিমা প্রকাশের জন্য নয় বরং সুরের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হয়েছে সৃষ্টিকর্তার মহিমা। ফাদার লেনার্ড রোজারিও’র ‘অর্ঘ্য মোর, অর্ঘ্য মোর লওগো ঈশ্বর, লওগো ঈশ্বর’ ধ্বনি শুনে ঈশ্বর সুরের যাদুকরকে স্বর্গে সুর সংযোজনের দায়িত্ব দিয়ে তুলে নিয়েছেন।