জন-জীবনের কথা
ফাদার সাগর কোড়াইয়া
রাগে, দুঃখে ও অসহ্য হয়ে বলার ভাষা নেই! কি এক করোনা ভাইরাস এলো; থমকে গিয়েছে জন-জীবন ব্যবস্থা। সব কিছু স্তব্দ আজ। জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান সময় ও ভবিষ্যত। ত্যাক্ত-বিরক্ত মানুষ সময়ের – স্রোতের বহু পিছনে পড়ে গিয়েছে। সব কিছু বন্ধ। স্কুল, কলেজ, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বেশী। শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই শিক্ষাকার্যক্রমের স্বাদ আস্বাদনে ব্যস্ত। আয়-উপার্জন বন্ধ থাকায় শহর ছেড়ে অনেকেই গ্রামমুখী বহু আগেই। পেশা পরিবর্তন করে স্বল্প আয়ের দিকে অনেকে ঝুঁকে পড়েছে। প্রথমত বাঁচতে হবে- এই আশায়! এই বাঁচাকে কতটুকু বাঁচা বলে সে প্রশ্ন আজ বড় নয় বরং পেটের ক্ষুধার কাছে সব দর্শনই যে তুচ্ছ তা স্পষ্ট।
করোনা পরিস্থিতির প্রায় দেড় বছর পরে এটা পরিষ্কার যে, করোনার উৎপত্তি ও বিশ্ব রাজনীতির দাবারচালে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি ও মানব জীবন ব্যবস্থা। এখন পানির মতো পরিষ্কার কোন দেশ বা গোষ্ঠির হীনস্বার্থ চরিতার্থই হচ্ছে করোনা ভাইরাস সৃষ্টির উদ্দেশ্য। এত কিছুর পরেও মানুষ থেমে নেই। জীবন চলছে জীবনের মত; কখনো দ্রুতলয়ে আবার কখনো ধীরলয়ে। কারণ, মানুষকে বাঁচতে হবে। তবে বাঁচার মতো বাঁচার ক্ষেত্রে একটা ছেদ যে পড়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যদিওবা করোনাকে ঠেকানোর নানা উপায় বের করা হচ্ছে কিন্তু করোনার প্রতিনিয়ত রূপ বদল মানুষের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। কেউ কি কখনো ভেবেছিলো যে, ক্ষুদ্র এবং অদৃশ্য এক ভাইরাস মানুষকে নাস্তাবুদ করে ছাড়বে! অনেকেই করোনা ভাইরাসের টিকা নিয়েছেন। কিন্তু এতেও নিশ্চয়তা নেই; কারণ টিকা বা ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
সব কিছুর পরও করোনাকালীন এই সময়ে মানুষ একটু আনন্দে বাঁচতে চায়। আর আনন্দে থাকার উপায়ও অনেকে নানাভাবে বের করে ফেলছেন। করোনার প্রথম সময় থেকেই মানুষের এই বাঁচা এবং করোনাকালীন জীবনযাত্রার নানা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। ভিডিওগুলো এতোটাই হাস্যকর; যে কখনো হাসেনি তাকেও হাসিয়ে ছাড়বে। গত বছর করোনা ভাইরাস যখন পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোকে অস্থির করে তুলছে তখন বাংলাদেশের অনেকে করোনাকে নিয়ে ব্যবসা পেতেছিলো। অনেককে বলতে শোনা গিয়েছে যে, ধর্মীয় লেবাসে জীবনযাপন করলে করোনা নাকি ধরবে না। কিন্তু সময় গড়াতে দেখা গিয়েছে যে, করোনা কোন ধর্ম, জাতপাত, বর্ণ, গোষ্ঠী, ছোট-বড় দেখে আসে না বরং করোনা আক্রান্ত হবার কারণ যে অসচেতনতা তাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস আগমনের শুরুর দিকে প্রশাসনিক সকল প্রকার বাধানিষেধ উপেক্ষা করে জনগণ রাস্তায় ঘুরাফেরা করতে থাকে। আইন করেও তা রোধ করা যায়নি। মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করা ছিলো দূরের কথা। প্রশাসন যখন লকডাউন দিয়েও মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে পারছে না সে সময় ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। কিভাবে জনগণকে ঘরে আটকিয়ে রাখা যায়। একজন ব্যক্তি খুব হাস্যরসাত্মকভাবে তা উপস্থাপন করে। লোকটির পরামর্শ হচ্ছে- পুলিশরা যেন সাথে করে রাস্তায় মেথর নিয়ে টহলে যায়। মেথরদের সাথে থাকবে মানুষের পায়খানা (মল); খাঁটি ভাবে বললে ‘গু’। যদি কেউ রাস্তায় বের হয় তাহলে সাথে সাথে পায়খানা বা মল ছুঁড়ে মারা হবে সে ব্যক্তির শরীরে। লোকটি দৌঁড়ে ঘরে চলে যাবে নিশ্চিত। সারাদিন সাবান মেখে গোসল করবে তাও নিশ্চিত। যদি আবার বের হয় আবারও ছুঁড়ে মারা হবে। উপস্থাপক লোকটি ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে এই পদ্ধতি কাজে দিবে বেশ।
করোনা ভাইরাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশের জনগণ করোনাক্রান্ত হয়নি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ তখন করোনায় বিপর্যস্ত। আমেরিকা, ইটালীর তখন কাহিল অবস্থা। অনেকে অনেক রকম মন্তব্য দিয়েছে যে, বাংলাদেশের মানুষের মশলা-ঝাল খাবার অভ্যাস আছে বলে নাকি করোনা হবে না। ইতোমধ্যে মশলা-ঝাল বাংলাদেশের মানুষের শরীরে এন্টিবডি তৈরী করে ফেলেছে। সে সময় একটি কৌতুক প্রচলিত হয়েছিলো যে, চীন সব সময় দুই ধরণের দ্রব্য তৈরী করে। তাই, চীন করোনা আবিষ্কার করে আমেরিকায় দিয়েছে এক নাম্বার করোনা ভাইরাস আর বাংলাদেশে পাঠিয়েছে দুই নাম্বার; দুই নাম্বার করোনা ভাইরাসের কার্যকারিতা কম। তাই, বাংলাদেশ করোনা ভাইরাস থেকে এখনো নিরাপদে আছে। আরো মজার ভিডিও ভাইরাল হয়েছিলো। যে ভিডিওর মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে এ দেশের বাস্তবতা। ইটালী থেকে করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে অবস্থানরত করোনা ভাইরাসের সাথে ফোনে কথা বলছে। ইটালীর করোনা ভাইরাস বলছে, কিরে ভাই ইটালীতে তো আমরা বহু মানুষ মারলাম কিন্তু বাংলাদেশে তো তোরা পুরাই ফ্লপ! বাংলাদেশের করোনা ভাইরাস যে উত্তর দিলো তা বেশ মজাদার, ভাইরে এদেশের মানুষ পানের সাথে যে চুন, খর, জর্দা খায় তা ভেদ করে প্রবেশ করা আমাদের পক্ষে কঠিন। প্রবেশ করলে নির্ঘাত মৃত্যু ঘটবে। আবার ঢাকা শহরে এমন এক নদী আছে যার পানিতে যত রাজ্যের ময়লা-আবর্জনা। সবাই সে পানিতে গোসল করে, মুখে পানি নিয়ে মুখ পরিষ্কার করে কিন্তু আশ্চর্য কারো কোন রোগ হয় না! আমরা তো সেখানে মামুলি ব্যাপার মাত্র!
কয়েক মাস পূর্বে একটি ভিডিওতে দেখলাম একজন মহিলা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় গ্যারান্টি দিয়ে বলছে, যারা বাংলা মদ খায় তাদের কখনো করোনা হবে না। এর কোন সত্যতা আছে কিনা জানা নেই। বেশ মজা পেলাম আরেকটি ভিডিও দেখে- একজন লোক করোনাকে সবচেয়ে বোকা ভাইরাস বলে আখ্যায়িত করছে। কারণ, করোনা এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে বিনা বাধায় প্রবেশ করছে কিন্তু করোনা এমনই বোকা যে সাধারণ মাস্ক ভেদ করে প্রবেশ করতে পারছে না। মাস্ক নিয়ে মানুষের মশকরার এখনো শেষ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মাস্ক মানুষকে পঁচানবব্বই ভাগ নিরাপত্তা দেয় তথ্যটাকে থোরাই কেয়ার করে। একজন সাংবাদিক একটি লোককে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি মাস্ক পড়েন না কেন! লোকটির সোজাসাপ্টা উত্তর, কেন মাস্ক পড়বো। আমার বাড়িতে কেউ মাস্ক পড়ে না, আমার পাশের বাড়ির কেউ মাস্ক পড়ে না। নানার বাড়ির কেউ পড়ে না। আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর কেউ মাস্ক পড়ে না; কেউ তো মারা যায়নি। আমি মাস্ক পড়ে কি মরবো!
করোনা মহামারীতে আরো যে কত ধরণের ঘটনা ঘটছে তা বলা মুশকিল। ভারতের একটি ভিডিওতে দেখলাম এক পুলিশ কর্মকর্তাকে গোমুত্র পান করতে। এ যেন সুমিষ্ট পানীয় জল পানের মতোই অবস্থা। যুক্তিরও শেষ নেই। গোমুত্র পান করলে নাকি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা নেই। যেখানে বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানী করোনা ভাইরাস নির্মূলের টিকা আবিষ্কারে ব্যর্থ সেখানে গোমুত্র যে কতটা করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারে তা প্রশ্নবিদ্ধ। করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে কত কথা বা তত্ত্ব যে আবিষ্কার হয়েছিলো তা বলা বাহুল্য। এক সময় প্রচার হয়ে পড়ে, বাড়ির সামনে মাটি খুঁড়ার পর কয়লা পাওয়া যাচ্ছে এবং সে কয়লা যে নিয়ে কপাল বা মাথায় মাখবে তাকে করোনা ভাইরাস কখনো আক্রান্ত করতে পারবে না। সে সময় দেখেছি এক একজনের কয়লা জোগাড় করার সেকি প্রচেষ্টা। অনেকে কপালে ও মাথায় মাখে। কয়লাই যদি করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক হতো তাহলে তো কোন চিন্তাই থাকতো না।
তখন করোনা ভাইরাস পুরোদমে পৃথিবীতে রাজত্ব করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করেছে, ঘন ঘন সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া এবং স্যানিটাইজ করলে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকা যাবে। বিভিন্ন সংস্থা থেকে সে সময় জনগণের হাতে স্যানিটাইজ করার জন্য স্যানিটাইজার দেওয়া শুরু হয়। ভারত থেকে সে সময় একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিলো। ভিডিওতে দেখা যায় এক বৃদ্ধের হাতে স্যানিটাইজ দেওয়া হলে বৃদ্ধ ভাবে হয়তোবা প্রসাদ দেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধটি স্যানিটাইজ কপালে ঠেকিয়ে খেয়ে নেয়। ভিডিওটি দেখে হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না। প্রশাসন যতই কঠোর আইন করে মানুষের জনসমাবেশে আসা আটকানোর চেষ্টা করে মানুষ যেন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক ভিডিওতে দেখছিলাম তিন যুবক মটরবাইক চালিয়ে মাস্কবিহীন পুলিশের সামনে পড়ে। তাদের ভাব এমন যে করোনা ভাইরাস তাদের কিছুই করতে পারবে না। কথায় বলে, বাঘের হাতে পড়লে এক ঘা আর পুলিশের হাতে পড়লে দশ ঘা! যাবি কোথায়; পুলিশ তিন যুবককে ধরে করোনা রোগী ভর্তি অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে ঢুকায়। করোনা রোগী দেখে যে করেই হোক অ্যাম্বুলেন্স থেকে বের হবার জন্য তিন যুবকের সেকি লম্ফঝম্প! শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ দিন যাবৎ বন্ধ থাকায় নানা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এই বছরের শুরুর দিকের ঘটনা। প্রাইমারী স্কুলের এক শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমাদের স্কুলের একজন শিক্ষকের নাম বলো তো! শিক্ষার্থী ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। শোনা গিয়েছে করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী বর্ণমালা ভুলে গিয়েছে। ভয়ানক অবস্থা নিঃসন্দেহে!
যাই হোক! করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে যেমন উৎকণ্ঠা রয়েছে তেমনি করোনা ভাইরাস নিয়ে হাসি-ঠাট্টারও শেষ নেই। করোনাকালে ঘটছে কত ঘটনা-রটনা। করোনার কারণে মানবজাতি অনেক শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছে যেমন- কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন, সাটডাউন, স্যানিটাইজার, মাস্কসহ আরো অন্যান্য। হয়তোবা এমন সময় সামনে আসছে যখন এই শব্দগুলোই হয়ে যাবে এক একটি নবজাতক শিশুর নাম। এটা সত্য যে, করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। আবার কবে ফিরে আসবে সেই স্বাধীন, নির্ভেজাল দিন। যখন মানুষ নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াবে সর্বত্র। আমরা সবাই করোনা ভাইরাস দূর হবার অপেক্ষায় আছি। যতদিন করোনা দূর না হয় ততদিন ঘটে যাক এইরকম আরো হাস্যরসাত্মক নানা ঘটনা; রটে যাক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অন্তত সবাই বলতে পারবে ঘটেছে তাই রটেছে আর তাই আনন্দ পেয়েছি। তবে তার চেয়েও বাস্তব সত্য হচ্ছে করোনা ভাইরাস অন্যান্য রোগের মতো পৃথিবীর বুকে রয়েই যাবে কিন্তু মানবজাতিকে রক্ষায় মানুষকে তার অভ্যাস-আচার-আচরণকে বদলাতে হবে। নয়তো মানবজাতি ডাইনোসরের মতো পৃথিবী থেকে এক সময় বিলীন হয়ে যাবে নিশ্চিত। ইতিমধ্যে করোনা ভাইরাসের প্রকট আক্রমণ কিছুটা স্থিমিত হচ্ছে। ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হচ্ছে বিশ্ববাসীকে। তবু ভয় থেকে যায়। মানুষের অবহেলায় না আবার করোনা ভাইরাস বৃদ্ধি পায়!