কলাম: জন-জীবনের কথা
ফাদার সাগর কোড়াইয়া
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে ভাওয়াল খ্রিস্টান অভিভাসনের শতবর্ষ অতিবাহিত হয়েছে। এরও পূর্ব থেকেই অন্য মণ্ডলির খ্রিস্টানগণ এসে এ এলাকায় বসতি গড়ে তোলেন। চাটমোহরের উত্থলী গ্রামের ব্যাপিস্ট মণ্ডলির খ্রিস্টভক্তগণকেই বলা যায় এ এলাকায় বসতি গড়ে তোলা প্রথম খ্রিস্টান। তবে অত্র এলাকার কাথলিক খ্রিস্টানগণ মথুরাপুর ধর্মপল্লীতে এসে প্রথম বসতি গড়ে তোলেন। ধারণা করা হয়, মথুরাপুর অর্থাৎ চাটমোহর এলাকা দিয়ে ব্রিটিশ আমল থেকেই রেল যোগাযোগের যাত্রা শুরু তাই চলাফেরার সুবিধার্থে ভাওয়াল থেকে আগত খ্রিস্টানগণ এই এলাকাতে এসেই বসতি গড়ে তোলার মনোস্থির করেন। যদিওবা সেই সময় অত্র এলাকাতে বর্তমান সময়ের মতো যোগাযোগের সুবিধা ছিলো না; সমগ্র এলাকাই ছিলো বন-জঙ্গল, বিল-জলাশয়ে ভরপুর। শোনা যায় দিনের বেলা একাকী চলাফেরা করা ছিলো রীতিমতো আতঙ্কের বিষয়। কারণ বাঘ, বন্য শুকর, সাপ ও অন্যান্য জীবজন্তু হরহামেশাই ঘুরে বেড়াতো। এছাড়াও মানুষের মনে ছিলো ভূত-প্রেতের ভয়। বর্তমান সময়ে স্মৃতিরোমন্থন করলে সব কিছু কেমন যেন অবাস্তবই মনে হয়। অবাক হতে হয়; বর্তমানে অধ্যূষিত ধর্মপল্লীগুলোর অনেক গ্রাম রয়েছে যেগুলো মিশন থেকে বহুদূরে অবস্থিত; যোগাযোগের ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত গড়ে উঠেনি। তৎকালীন সময়ে তাহলে কেমন ছিলো! যেমন- মথুরাপুর ধর্মপল্লীর ফৈলজানা গ্রাম, তারও দক্ষিণ-পূর্বে চাচকিয়া গ্রাম ছিলো অজপাড়াগাঁ (সে সময় মথুরাপুর ধর্মপল্লীর অধিনস্ত গ্রাম), জগতলা, কাতুলী, লাউতিয়া (জঙ্গলে ঘেরা দূরের গ্রামই ছিলো), বোর্ণী ধর্মপল্লীর প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামই বিলের ধারে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন গ্রাম। বিশেষভাবে চামটা গ্রামের চলনবিলের ধারে বোর্ণীর প্রথম গীর্জা ছিলো। বনপাড়া ধর্মপল্লীর বাহিমালী, কালিকাপুর, শ্রীখন্ডি ও ভবানীপুর গ্রামগুলো ছিলো পান্ডবর্জিত । প্রশ্ন জাগে- বিল অধূষ্যিত জলাশয়পূর্ণ জঙ্গল এলাকায় কেন প্রথমদিককার খ্রিস্টভক্তগণ বসতি গড়তে গেলেন! একটু পিছনের দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- এই গ্রামগুলোতে যারা প্রথম বসতি গড়ে তোলেন তারা অধিকাংশই গাজীপুরের ভাওয়াল অঞ্চলে বসবাস করার সময় ঠিক একই ধারার পরিবেশের মধ্যেই বসবাস করতেন। এই এলাকায় এসেও একই ধারা ত্যাগ করতে পারেননি।
মথুরাপুর ধর্মপল্লীতে এখনো অনেকেই আছেন যাদের জন্ম গাজীপুরের ভাওয়াল অধ্যূষিত ধর্মপল্লীতে। সবাই শিশু বা কৈশোরকালীন সময়ে পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজনের হাত ধরে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের দক্ষিণ ভিকারিয়ায় চলে আসেন। এখনো তারা মনে করতে পারেন সেই ফেলে আসা স্মৃতিগুলোকে। মথুরাপুর ধর্মপল্লীর অনেকের মধ্যে এ রকম তিনজন ব্যক্তি হলেন মথুরাপুর গ্রামের ভিনসেন্ট গমেজ ও রোজবেন রোজারিও এবং জগতলা গ্রামের সিলভেস্টার গমেজ। এই তিনজনের সাথে গল্পোচ্ছলে তুলে আনা হয়েছে অনেক না জানা ইতিহাস। এছাড়াও দক্ষিণ ভিকারিয়ার খ্রিস্টানদের পথপ্রদর্শক পল গমেজের (পলু শিকারী) নাতি বার্ণার্ড গমেজের (বারো) দাদুর সাথে কিছু স্মৃতি তুলে ধরার প্রয়াস চালানো হয়েছে। এদের মধ্যে সিলভেস্টার গমেজ ও বার্ণার্ড গমেজ সম্প্রতি স্বর্গবাসী হয়েছেন।
১৪ টাকা সম্বল করে যমুনা পাড়ি দিয়ে রাজশাহীতে আসেন
ভিনসেন্ট গমেজ এবং রোজবেন রোজারিও দু’জন স্বামী স্ত্রী। দু’জনের জন্মই গাজীপুরের ভাওয়ালে। ভিনসেন্ট গমেজের জন্ম রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর জয়রামবের গ্রামের চদরী বাড়িতে। পিতা জিমি গমেজ ও মাতা চামেলী কোড়াইয়া। ভিনসেন্ট গমেজের পিতামাতা ভিনসেন্ট যখন ৩/৪ বছর বয়সের তখন মাত্র ১৪ টাকা সম্বল করে যমুনা পাড়ি দিয়ে রাজশাহীতে চলে আসেন। সেই সময়কার কোন স্মৃতি ভিনসেন্ট গমেজের মনে নেই। প্রথমেই মানগাছাতে বাড়ি ছিলো। ভিনসেন্ট গমেজের বাবা বনপাড়াতে মাত্র চার আনা পয়সা রোজে কাজ করে সংসার চালাতেন। পরবর্তীতে মানগাছা থেকে ছিটকীগাড়ি কেরাণী বাড়িতে চলে আসেন। কেরাণী বাড়ি থেকে মথুরাপুরে চলে এসে মন্সিনিয়র মাইকেল রোজারিও’র ভাই আকাইল্লে রোজারিও’র নিকট থেকে ২৫ টাকায় জমি করপা (লিজ) নেন এবং বর্তমান সিস্টার কনভেন্টের জমিতে বাড়ি করেন। এ সময় ভিনসেন্ট গমেজ মথুরাপুর জঙ্গল থেকে বের হয়ে শুকর ফসলাদি নষ্ট করলে জঙ্গলী শুকর তাড়াতেন। একবার ভিনসেন্ট গমেজ অসাবধানতাবশত আগুন দিয়ে ঘর পুড়িয়ে দিলে ভিনসেন্ট গমেজের বাবা নরেশ ও গ্যাদার বাড়ি ও জমি (বর্তমান ভিনসেন্ট গমেজের বাড়ি) ক্রয় করেন (এ সময় নরেশ ও গ্যাদা জমি বিক্রি করে বোর্ণীর সংগ্রামপুরে চলে যান)।
রোজবেন রোজারিও তৎকালীন তুমিলিয়া ধর্মপল্লীর দড়িপাড়া গ্রামের চহের বাড়ির আন্দ্রেজ রোজারিও ও ভির্জিনিয়া ক্রুজের কোলে জন্মগ্রহণ করেন। রোজবেন রোজারিও’র মনে পড়ে যে, দড়িপাড়া ভাঙ্গা স্কুলে তিনি পড়াশুনা করেছিলেন। বড়দিদি মার্তিস পানজোড়া বোর্ডিং-এ থেকে পড়াশুনা করতেন আর মেজ দিদি রাঙ্গামাটিয়ার ছোট সাতানীতে বিয়ে হন। রোজবেন রোজারিও’র বাবা কলকাতায় ৫ টাকা বেতনে বাবুর্চি চাকুরী করতেন; তবে টাকা-পয়সা রাখতে পারতেন না। নিজের জায়গা-জমি ছিলো মাত্র সোয়া বিঘা। জেঠাতো ভাইকে লিখে দিয়ে এলেও সে টাকা আর পাওয়া যায়নি। রোজবেন রোজারিও’র বাবা আগে এসেই বর্তমান ভাদড়ার ফচকার বাড়ির পশ্চিম দিকে দুটি ঘর তুলে আবার ঢাকায় সবাইকে নিয়ে আসার মনোস্থির করেন। তবে যাওয়ার আগের দিন দুর্বৃত্তরা ঘরে আগুন জ্বালিয়ে সব পুড়িয়ে ফেলে। মনোকষ্টে লাউতিয়া গির্জায় গেলে তামি কস্তা (বুইড্ডাগো বাড়ি) সব শুনে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তামি কস্তার পরামর্শে রাজাডিয়ার গ্রামে বিঘা প্রতি ৩৫ টাকায় ৪ বিঘা জমি ক্রয় করেন।
বাবা গাজীপুরে ফিরে যান স্ত্রী-সন্তানদের আনার জন্য। রোজবেন রোজারিও’র আজও মনে পড়ে, হাড়িখোলা স্টেশন থেকে বাবা-মায়ের সাথে ট্রেনে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। দু’বোন তাদের বিদায় দিতে এসে সে কি কান্না! টঙ্গী স্টেশন থেকে ট্রেনে যমুনা নদী। লঞ্চে যমুনা নদী পাড় হওয়ার সময় কলাপাতায় মুড়িয়ে আনা ভাত সবাই ভাগ করে খান। অতঃপর যমুনার পশ্চিমপাড়ে এসে আবারও ট্রেনে যাত্রা। চাটমোহরে ট্রেন থেকে নেমে ঘোড়ায় টানা গাড়িতে (টমটম) চড়ে মথুরাপুরে আসেন। এরপর তো এখানকারই বাসিন্দা।
ভিনসেন্ট ও রোজবেন দু’জনই বলছিলেন, সেই যে ভিটেমাটি ফেলে এসেছি তবু কেন জানি ভাওয়াল এখনো ডাকে। পালা-পর্বে বেড়াতে গিয়েছি ঠিকই কিন্তু ভাওয়ালের নিঃশব্দ বাতাস মাঝে মাঝে হৃদয়ে বাজে। একশত বছর পাড় করছি ভাওয়াল থেকে আগমনের; ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। বর্তমানে সবাই শিক্ষিত ও উচ্চ বেতনে চাকুরী করে। অভাব নেই যেমন তেমনি দরদবোধও হারিয়ে যাচ্ছে। আর সে দরদবোধ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও মণ্ডলির প্রতি।
সে সময় চাটমোহর রেলস্টেশনে শুধুমাত্র ১টি চায়ের দোকান ছিলো
সিলভেস্টার গমেজ (ছিলু) তুমিলিয়া ধর্মপল্লীর বাঙ্গালহাওলা গ্রামের হুড়িগো বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ভাওয়ালে থাকাকালীন সময়ের অনেক স্মৃতিই তিনি স্মরণে আনতে পারেন। বিশেষভাবে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা তিনি স্বচোখে দেখেছেন। হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা হয়। বাড়িঘর সারারাত ধরে জ¦লতো। খ্রিস্টান বাড়িতে এসে হিন্দুরা আশ্রয় নিতো। দাঙ্গার পরের বছর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের দূর্ভিক্ষ (আহাল) ছিলো দূর্বিসহ। মানুষের এমনই অভাব ছিলো সে সময় অন্যের বাড়ি থেকে ভাতের মাড় সংগ্রহ করে খেয়ে অনেকে বেঁচে ছিলেন।
এ এলাকায় আসার একটি বড় কারণ হচ্ছে বড় ভাই টমাস গমেজকে খুঁজে বের করা। মানুষের মুখে শোনা যেতো যে, টমাস গমেজ চাটমোহর-দর্শনা রেল লাইনে ব্ল্যাকে কাজ করতো। সিলভেস্টার গমেজ (ছিলু) মথুরাপুর এলাকায় আসার পূর্বে পিতার সাথে এসে জমি দেখে যান। সে সময় বিশপ ফ্রান্সিসদের বাড়িতে এক সাপ্তাহ থাকেন। সে সময় কেমন ছিল সবকিছু- জিজ্ঞাসা করতেই সিলভেস্টার গমেজ (ছিলু) জানালেন, চারিদিক ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ। বিন্নাঝোপ ছিল মাত্রাতিরিক্ত। জগতলা বিল পতিত পড়ে থাকতো। জমি সস্তা, উৎপাদন কম হতো। আয় কম কিন্তু জিনিষের দাম ছিলো বেশী। চাটমোহর স্টেশনে ১টি মাত্র চায়ের দোকান ছিল।
বৃদ্ধ বয়সেও দাদু বেশ সাহসী ছিলেন
বার্ণার্ড গমেজ (বারো) পল গমেজ ওরফে পলু শিকারীর ছেলের ঘরের বড় নাতি। বার্ণার্ড গমেজ দাদুর সান্নিধ্যে থেকে দাদুর বিষয়ে অভিজ্ঞতা করেছেন বিস্তর। কৈশোরের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি বলেন, দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন কাতুলী গ্রামে। সে সময় আন্তুনী মাষ্টার পড়াতেন। মিশন প্রাঙ্গণে যে স্কুল সেখানে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। দাদু আমাকেই দাদু বলে সন্মোধন করতেন। দাদু ৫/৬ মাস শিক্ষকতাও করেছেন প্রাইমারী স্কুলে। তিনি চাউল গুড়া দিয়ে চা খেতে ভালবাসতেন। প্রচন্ড ঝালও খেতেন। আর সে কারণে পেটে আলসার রোগ ধরা পড়ে। আমি ঢাকায় চাকুরী করার সময় দাদুকে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসাও করিয়েও ছিলাম।
দাদুর পছন্দ করা মেয়েকেই আমি বিয়ে করি। দাদু আমার স্ত্রী ও আমাকে অনেক আদর করতেন। মনে পড়ে দাদুর সাথে বেশ কয়েকবার নাগরীর বাগদী গ্রামে বেড়াতে যাই। দাদু আনারস কেঁটে দিতেন। বৃদ্ধ বয়সেও দাদুকে বেশ সাহসী অবস্থায় দেখেছি। আমার বাবা যোসেফ গমেজকে একবার শুকর আক্রমণ করলে দাদু তাকে বাঁচান। পলু শিকারীর নাতি হতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। দাদু বেশ পরোপকারী মানুষ ছিলেন। ছেলেমেয়েদের আদর করতেন খুব। মাঠে খেলা হলে দাদু সব সময় খেলা দেখতে যেতেন এবং নিজেও খেলতে পছন্দ করতেন। কাতুলী গ্রামের ছুলু চার্লির সাথে ঠাকুরের গীতে দাদু দোয়াড় টানতেন।
দিনে দিনে আমাদের আগের মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছেন। হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতির দর্পণের কথামালা। আর কয়েক বছর পর আমরা বর্তমান প্রজন্ম আরেকটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি যখন ভাওয়াল থেকে আগত ব্যক্তিগণ আর থাকবেন না। আমরা হয়ে যাবো অভিভাবকহীন। রাতের আঁধারে বসে তারা নতুন স্বপ্ন নিয়ে আর বলবেন না- ‘যমুনা পাড়ি দিয়ে আরেকটি সমুদ্রসমতুল্য জলরাশির খোঁজে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম’। কল্পনায় স্মৃতির দর্পণ উন্মোচন করলেই শরীর শিউরে উঠে! কি ভয়ংকর ছিলো সে যাত্রা! সম্পূর্ণ নতুন দেশের দিকে যাত্রার মতো। যেখানে নেই কোন নিশ্চয়তা, ভবিষ্যত। ভারতীয় বাংলা গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান ‘নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবী আর পৃথিবীর পরে ঐ নীলাকাশ’ গানটির লাইনের মতো বলা যায়, এক অন্য নীলাকাশ ও পৃথিবী দেখেই পূর্বপুরুষগণ এই এলাকায় এসেছিলেন।