জন-জীবনের কথা
সাগর কোড়াইয়া
৩০ নভেম্বর, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ। দিনটি বৃহস্পতিবার। সকাল ১০:০০ ঘটিকার পূর্বেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও বাংলাদেশ মণ্ডলির গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে ভরপুর। সবাই আকাশপানে চেয়ে আছে কখন পুণ্যপিতা ফ্রান্সিসকে বহনকারী বিমান মিয়ানমান থেকে এসে অবতরণ করবে। সবাই অপেক্ষায় আছে পুণ্যপিতাকে দেখার জন্য। ঠিক একই চিত্র দেখা গিয়েছে ১ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ভোরবেলা থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খ্রিস্টবিশ্বাসীর ঢল এসে জড়ো হতে থাকে সোহরাওয়ার্দী মাঠ প্রাঙ্গণে। এ যেন এক তীর্থোৎসবে পরিণত হয়। স্লোগানে ভরে উঠে দিক্-বিদিক্ ! সব কিছুকে ছাড়িয়ে সবার চোখ চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকে পুণ্যপিতা ফ্রান্সিসের কোমল মুখোয়বটি দেখার প্রতীক্ষায়। মন-প্রাণ ও চক্ষুর তৃষা মেটাতে চায় পুণ্যপিতাকে দেখে। অবশেষে পুণ্যপিতা ফ্রান্সিস এলেন। সবাই তাকিয়ে রইলো পুণ্যপিতার দিকে। আহা! কি হৃদয় জুড়ানো মূহুর্ত ছিলো সেগুলো! অনেকে পুণ্যপিতাকে দেখে আনন্দাশ্রু ফেলেছেন। এ রকম আরো বহু স্মৃতি পুণ্যপিতা ফ্রান্সিসকে নিয়ে। পুণ্যপিতা ফ্রান্সিসের আগমন বিষয়ে আলোকপাত করা এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। তবু বলি- বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরুর আগমনে যে প্রস্তুতি ও প্রতীক্ষা; যিনি মানুষের হৃদয়ের সর্বোচ্চ স্থানে আসন নিতে চান সেই যিশুগুরুর আগমনকে সাদরে বরণ করে নিতে আমাদের অপেক্ষা ও প্রস্তুতি আরো কত না থাকা উচিত। সবার উপলব্ধিতে আনা দরকার- আগমনকাল হচ্ছে যিশুকে গ্রহণ করে নিতে মণ্ডলিকর্তৃক প্রদত্ত প্রস্তুতি ও অপেক্ষার সময়।
বছরের শেষের দিকে শীত আসি আসি করে। ভোরে ঘাসের ডগায় শিশির জমে থাকে। বাগ-বাগিচা বাহারী ফুলে ভরে যায়। প্রকৃতির এই রূপ বদলের পাশাপাশি মণ্ডলির কালের পরিবর্তন হয়। মণ্ডলিতে আগমনকাল আসে। খ্রিস্টভক্তদের আত্মিক প্রস্তুতির জন্য আগমনকাল আশির্বাদ হয়ে দেখা দেয়। তাই মণ্ডলিতে আগমনকাল সুন্দর ও পবিত্র একটি সময়। এ সময় যিশুর জন্মোৎসব বড়দিন উদ্যানের জন্য বাহ্যিক প্রস্তুতিটাও চোখে পড়ার মতো। আগমনকালের ইতিহাস পর্যালোচনা দেখা যায় যে, আগমনকাল এবং বড়দিনের মধ্যে তেমন কোন সম্পর্ক ছিলো না। ইতিহাসবিদগণ ধারণা করেন- চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দিতে স্পেন এবং ফ্রান্সে (ফ্রান্সের তৎকালীন নাম গল) আগমনকাল ছিলো জানুয়ারি মাসে যিশুর আত্মপ্রকাশ পর্বে নতুন দীক্ষাপ্রার্থীদের দীক্ষা লাভের জন্য প্রস্তুতির সময়। এই সময় দীক্ষাপ্রার্থীরা ৪০ দিন যাবৎ প্রার্থনা, উপবাস ও ত্যাগস্বীকারের মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রস্তুত করতো। পরবর্তীতে ষষ্ঠ শতাব্দিতে রোমীয় খ্রিস্টানগণ যিশুর আগমনের প্রস্তুতিস্বরূপ আগমনকালকে বেছে নেয়। তবে যিশুর বেথলেহেম নগরে গোশালায় জন্মগ্রহণকে স্মরণ করে নয় বরং পৃথিবীর বিচারক হিসাবে মেঘবাহনে যিশুর দ্বিতীয় আগমনকেই বিবেচ্য করে।
আগমনকালের চারটি সপ্তাহে চারটি মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে চারটি মূলভাবকে কেন্দ্রে নিয়ে মণ্ডলি ধ্যান-প্রার্থনা করে থাকে। প্রথম মোমবাতিটি হচ্ছে আশার প্রতীক। এই মোমবাতিটিকে প্রাবক্তিক মোমবাতিও বলা হয়। বিশেষত প্রবক্তা ইসাইয়া নতুন মোশীহের আগমনের আশার বাণী শুনিয়েছেন। দ্বিতীয় মোমবাতিটি বিশ্বাসকে প্রকাশ করে এবং বেথলেহেমের মোমবাতি হিসাবে আখ্যায়িত। প্রবক্তা মিখা ভবিষ্যত বাণী করে বলেন, মোশীহ বেথলেহেমে জন্মগ্রহণ করবেন। আর এই বেথলেহেম রাজা দায়ূদেরও জন্মস্থান। তৃতীয় মোমবাতিটি আনন্দকে প্রকাশ করে; যা মেষপালকের মোমবাতি হিসাবে পরিচিত। স্বর্গদূতগণ সর্বপ্রথম মেষপালকদের কাছে যিশুর জন্মের আনন্দ সংবাদ পৌঁচ্ছে দেন। চতুর্থ মোমবাতিটি শান্তির প্রতীক আর এই মোমবাতিটিকে স্বর্গদূতদের মোমবাতিও বলা হয়। কারণ স্বর্গদূতগণ ঘোষণা করেন যে, যিশুখ্রিস্ট শান্তি নিয়ে এসেছেন। যদিওবা পঞ্চম মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের কোন রীতি নেই তবু অনেক দেশে, কৃষ্টি ও রীতিতে পঞ্চম একটি মোমবাতি অন্যান্য চারটি মোমবাতির সাথে বড়দিনের দিন জ্বালানো হয়ে থাকে। আর এই মোমবাতিটি খ্রিস্টের মোমবাতি হিসাবে পরিচিত।
আগমনকাল অপেক্ষার সময়। মানুষের যে কোন অপেক্ষার প্রহর এক সময় শেষ হয়। আগমনকালের চারটি সপ্তাহ অপেক্ষা ও প্রস্তুতির পর যিশুর জন্ম আমাদের জন্য আনন্দ বয়ে আনে। এছাড়াও আগমনকাল নির্দেশ করে যে, যিশু আসবেন মহাপরাক্রমে; আর এই দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় আছে বিশ্বাসীভক্ত মণ্ডলি। তবে তার আগে আগমনকালের গভীর অর্থ আমাদের বুঝতে হয়। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থার দিকে ফিরে যাচ্ছে। বিগত দুই বছর যাবৎ মানুষ ভীত-সন্ত্রস্থ অবস্থার মধ্যে বাস করেছে। সবাই অপেক্ষায় ছিলো এই দূরাবস্থা কবে দূর হবে। করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার ও পরবর্তীতে তা গ্রহণের আকাঙ্খায় সবার দিন কেঁটেছে। অবশেষে অপেক্ষার হয়েছে জয়। তদ্বরূপ আমাদের আশে-পাশের দরিদ্র ভাই-বোনদের দিকে তাকানো উচিত। একদিকে সমাজ ও দেশের অনেকে দিনে রাতে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে রূপ নিচ্ছে আর অন্যদিকে দরিদ্ররা অপেক্ষায় আছে উপকারী ব্যক্তির আশায়। দরিদ্রদের অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চায় না। আগমনকাল সমাজের অবহেলিত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিত ও অনাহারী মানুষের অপেক্ষার প্রহর দূর করার আহ্বান জানায়। ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে ভাটিকানে যে সিনড অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তার প্রস্তুতিস্বরূপ যে মূলভাব “সন্মিলিত মণ্ডলি: মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণকর্ম” দ্বারা আলোকিত হয়ে দরিদ্রদের পাশে দাঁড়িয়ে সবার মিলন ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সন্মিলিত মণ্ডলি গঠনের লক্ষ্যে দীক্ষাপ্রাপ্ত সবাইকে প্রেরণকার্যে একযোগে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জাগায় আগমনকাল।
মানুষ অপেক্ষা করতে চায় না।মূহুর্তে পাবার আকাঙ্খা সব সময়। বাস বা রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়, কখন গাড়ি বা ট্রেন আসবে সে প্রতীক্ষায়। বারে বার রাস্তার দিকে চোখ চলে যায়। গাড়ি বা ট্রেন আর কতদূর দেখবার আশায়! দূর থেকে গাড়ির আলো বা হর্ণ শুনতে পেলে খুশিতে ভরে যায় বুক। বাড়িতে বিশেষ অতিথি আসবে জানলে কত রকমের প্রস্তুতি চোখে পড়ে। অনেকে আবার অতিথিকে বরণ করতে দূরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। মানুষের জীবন আগমন, অপেক্ষা, প্রতীক্ষা দ্বারা আচ্ছাদিত। আগমন না থাকলে আশা থাকতো না। আশা না থাকলে জীবনের অর্থ বৃথা হতো। আর বৃথা হওয়া মানে লক্ষ্যহীন পথচলার। যিশুও আমাদের হৃদয় পরিবারে আসবেন। আর তাই আগমনকালই হচ্ছে প্রস্তুতির সুন্দর সময় যিশুকে বরণ করার। আগমনকাল আমাদের জীবনে মা মারীয়ার যিশুকে গর্ভে ধারণের মতো উপহারস্বরূপ। আগমনকাল আমাদের জন্য হতে পারে একটু সময় বের করে ধ্যান-প্রার্থনার মধ্য দিয়ে শিশু যিশুকে বরণ করার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরীয় ভালবাসাকে উপহার হিসাবে গ্রহণ করার। আগমনকালে আমাদের হৃদয়-মন আগমনকালীন সঙ্গীত “হবে তাঁর আগমন, আমরা অনুক্ষণ রয়েছি প্রত্যাশায়, মুক্তির প্রতীক্ষায়” দ্বারা আন্দোলিত করি।