গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাডিমির পুটিন মস্কো সময় সকাল ৬টায় ইউক্রেইনে সামরিক অভিযানের ঘোষণা দেন। ঘোষণার পর পরই, আগে থেকেই ইউক্রেইন ঘিরে রাখা রুশ বাহিনী সামরিক অভিযান শুরু করে। তবে তার আগে গত ২১ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট পুটিন ইউক্রেইনে রুশ অধ্যুষিত ডোনেৎস্ক এবং লোহান্সক ডোনবাস) অঞ্চলকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, “আরো আগেই এই ঘোষণার প্রয়োজন ছিলো।” মস্কো সমর্থনপুষ্ট বিচ্ছিন্নবাদী রুশ অধ্যুষিত এই ডোনবাস অঞ্চলের বামপন্থীরা ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইউক্রেইন থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য কিয়েভ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে আসছিলো। সে বছর ক্রেমলিন সরকার সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়া জর্জিয়া প্রজাতন্ত্র আক্রমন ক’রে রুশ অধ্যুষিত ক্রিমিয়া দখল করে নিজের করে নেয়। একইভাবে রাশিয়ার ইউক্রেইন আগ্রাসনের কারণ হলো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দু’টি অঞ্চলকে নিজের করে নেওয়া। যেমন নিয়েছে জর্জিয়া দেশের ক্রিমিয়া। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ১৫টি প্রজাতন্ত্র স্বাধীন হওয়ার যন্ত্রণা এখনো রুশ নেতারা ভুলতে পারেননি। প্রেসিডেন্ট পুটিনের ইউক্রেইন হামলার সবচেয়ে বড় কারণ হতে পারে- ইউক্রেইনের ন্যাটোভূক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত। পুটিন বার বার বলে আসছেন, ইউক্রেইন যদি ন্যাটোভূক্ত হয়- তা হবে রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। বেলারুশ বাদে এক সময়কার সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থনপুষ্ট ওয়ার্শোভূক্ত পূর্ব ইউরোপ ও বাল্টিক দেশগুলো এখন ন্যাটোভূক্ত এবং এই জোটের সহযোগী।

বিংশ শতাব্দিতে দু’টি বিশ্বযুদ্ধই শুরু হয়েছিলো বর্তমান ইউরোপ মহাদেশ থেকে। সেই ইউরোপেই আরো একটি ভয়াবহ যুদ্ধের অবস্থা তৈরি হতে পারে- নেতাদের ধৈর্যের বিচ্যুতি ঘটলে। এখন একটি বিশ্বযুদ্ধ বাঁধলে সেটা হবে পারমাণবিক যুদ্ধ। পারমাণবিক যুদ্ধ মানে কেউ হারবে না, কেউ জিতবেও না। উভয় পক্ষকেই ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে মনে হয় রুশ প্রেসিডেন্ট যুদ্ধের গুটি যেনো অন্যের কোটে গিয়ে না পড়ে সেই দিকটার হিসাব কষেই মাঠে নেমেছেন। তিনি নিশ্চিত হয়ে আছেন যে- ন্যাটো জোট এই যুদ্ধে সেনা পাঠাবে না। তাদের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে ইরাক ও আফগানিস্তানে। তবে পশ্চিমা নেতারা রাশিয়ার উপর অর্থনীতিসহ যে নানা অবরোধ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে- সেগুলো অদূর ভবিষ্যতে রাশিয়ার উপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। কারণ আর এক সুপার পাওয়ার চীন এখন রাশিয়ার সঙ্গে রয়েছে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চললে- রাশিয়ার মধ্যেই পুটিনবিরোধী জনমত গড়ে উঠতে পারে- এমন সন্দেহ করা যেতে পারে। আর তা পুটিনের আসন নড়বড়ে করে দিতে পারে। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে রুশ নেতারা সেটাকে তাদের অর্থনৈতিক পরাজয় হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন- রাজনৈতিক পরাজয় নয়। রাশিয়ায় আবার একটি অর্থনৈতিক পরাজয় ঘটুক- তারা তা চাইবে না। তবে চীনারা অতি চতুর জাতি। তারা এখন স্বার্থের কারণে ও ন্যাটোকে শিক্ষা দেওয়ার কারণে রাশিয়ার সঙ্গে থাকলেও খাল কেটে কুমির আনবে না।

তবে বিশ্ব, যুদ্ধে জড়িয়ে যাক বা না যাক- এর পরিণতি বিশ্বকে ভোগ করতে হবে। রাশিয়া বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তর জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশ। মস্কোর জ্বালানি গ্যাস পাইপ লাইন ইউরোপ পযর্ন্ত বিস্তৃত। রাশিয়া এবং ইউক্রেইন বিশ্বের অন্যতম গম রপ্তানি দেশ। তৈরি পোশাক শিল্পের এখন বড় বাজার রাশিয়া। ইতিমধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার ছুঁইয়েছে। বিভিন্ন দেশে শেয়ারমার্কেট, পুঁজি বাজারে দর পতন শুরু হয়ে গেছে। ফলে করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ব বাণিজ্য যে স্থবির হয়ে আছে- সেটা আরো বিস্তৃত হবে। রাশিয়া ও ইউক্রেইনের বিশাল আকাশপথ বিমান চলাচলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। রাশিয়া ইতিমধ্যে তার আকাশ সীমানায় যুক্তরাজ্যের বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রপথেও বিশ্ব বাণিজ্য সীমিত হয়ে পড়বে।

রাশিয়া এবং ইউইেক্রন দু’টিই খ্রিস্টান দেশ। রাশিয়ার মোট জনসংখ্যা ১৪৫.৫ মিলিয়ন, যার মধ্যে ৭৩ শতাংশ খ্রিস্টান এবং ৭১ শতাংশই অর্থোডক্স খ্রিস্টান, এক শতাংশ ক্যাথলিক এবং ১০ ভাগ মুসলিম। রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টান দেশ। অন্যদিকে ইউক্রেইন প্রজাতন্ত্রের মোট জনসংখ্যা ৪১.২ মিলিয়ন যার মধ্যে ৮২ শতাংশ খ্রিস্টান এবং ৭২ শতাংশই অর্থোডক্স ও ৮.৮ গ্রিক ক্যাথলিক। ইউক্রেইনের অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের মধ্যে ৫৮.৩ শতাংশ ইউক্রেইনীয়ান অর্থোডক্স এবং ২৫.৪ শতাংশ খ্রিস্টান মস্কো প্যাট্রিয়ার্ক চার্চপন্থী। ইউক্রেইন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টান দেশ। দেশটির মোট আয়তন দুই লাখ, ৩৩ হাজার ৬২ বর্গমাইল এবং আয়তনের দিক থেকে রাশিয়ার পরেই ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ।

ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ইতিমধ্যেই এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান তুলে ধরেছেন। পোপ বলেছেন, “যুদ্ধ হলো রাজনৈতিক পরাজয় এবং মানবতার পরাজয়।” পোপ গত ২৫ তারিখে প্রটোকল ভেঙ্গে ভাটিকানস্থ রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রুশ সেনাদের ইউক্রেইন আক্রমনে তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন। পোপ রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনকে “মানবতার লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ” হিসেবে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “প্রতিটি যুদ্ধ বিশ্বকে আজকের অবস্থান থেকে খারাপ অবস্থানে ঠেলে দেয়।” ভাটিকান থেকে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম পোপের এই অবস্থানকে “বিস্ময়কর” বার্তা হিসেবে মন্তব্য করেছে।

বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : ফাদার সুনীল রোজারিও

Please follow and like us: