ফাদার সাগর কোড়াইয়া
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তার ‘তৈল’ প্রবন্ধে তৈল লেপনের গুণগান করেছেন। তিনি বলেছেন, তৈল লেপনে চাকা ঘোরে আবার আরেক তৈলে মানুষের মনও গলে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় যদি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী জন্মগ্রহণ করতেন তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় কোনভাবেই তিনি উপরোক্ত লাইনটি লিখতেন না। হয়তোবা লিখতেন, তৈল লেপনে চাকা ঘোরে আর তৈলবাজিদের কার্যও উদ্ধার হয়। বাস্তব সত্য হচ্ছে যারা তেলবাজি তাদের তেলের ডিব্বা বেশ ভারি হয়, আর যোগ্যতার পারদ থাকে কম। তারা জানে কিভাবে তেললেপনে কাজ উদ্ধার সম্ভব। তেলবাজ অল্প সময়ের জন্য আনন্দের আতিশয্যে হাওয়ায় ভাসতে থাকে কিন্তু এক সময় সে তেলবাজের সকল তেলের ডিব্বা উন্মোচিত হয়ে পড়ে।
তৈলবাজ শব্দের অনেকগুলো সমার্থক শব্দ রয়েছে। চাটুকারী, তোষামোদকারী, চামচা, স্তাবক, খোশামুদে, তোয়াজকারী, মোসাহেবি, পদলেহন শব্দগুলো যথাযথ বলে মনে করি। তৈলবাজ স্বভাবের মানুষগুলো দু’ধারি কৃপাণের মতো। তারা দু’দিক দিয়েই কাঁটতে চায়। তেলবাজরা ভণ্ডদের সাথে তুলনীয়। তেলবাজি নিয়ে একটি মজার গল্প রয়েছে। এক প্রবল পরাক্রমশালী কর্তাব্যক্তি সকালে প্রাতঃভ্রমণে বেড়িয়েছেন। সঙ্গে গিয়েছেন তার এক চাটুকার। পার্কে গাড়ি থামিয়ে সেই কর্তাব্যক্তি জগিং করতে গেলেন। জগিং থেকে ফিরে সেই কর্তাব্যক্তি দেখলেন তার সেই চাটুকার কর্মী হাঁপাচ্ছেন। তিনি একটু আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, কি ব্যাপার জগিং করলাম আমি আর তুমি কেন হাঁপাচ্ছ? চাটুকার হাত কচলাতে কচলাতে উত্তর দিল, হুজুর! জগিংও আপনি করবেন আর হাঁপাবেনও আপনি। দুটো কাজ করতে আপনার কষ্ট হবে না? তাই আপনি জগিং করেন আমি হাঁপাচ্ছি।
তেলবাজ তেল ও চিনির মতো ব্যক্তি ও সমাজের ক্ষতি করে থাকে। তেল ও চিনি কখনোই শরীরের জন্য স্বাস্থ্যপ্রদ নয়। উভয়ই শরীরে ক্যান্সারের বাসা বাঁধে। তেলবাজ ব্যক্তিও ঠিক সমাজে ক্যান্সারের মতো। তেলের দাম বাড়ে কমে কিন্তু সমাজে তেলবাজি ব্যক্তি কমে না। তেলবাজি সব সময় তেললেপনে কাজ আদায় করে নিতে চায়। আবার নিজ স্বার্থ উদ্ধার করতে সক্ষম না হলেও কর্তাব্যক্তির কানে বিষবাক্য ঢেলে যোগ্য মানুষগুলোকে পচানো বা কর্তাব্যক্তির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কাজে এরা সিদ্ধহস্ত হয়। একে অপরের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভেদ ও বিবাদ লাগাতে ওস্তাদ। তৈলবাজরা সব সময় কর্তাব্যক্তির সন্মুখে মাথা নত করে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে পায়ের দিকে চোখ রেখে অতি আপনজনের সুরে কথা বলে। কারণ তেলবাজরা নৈতিকভাবে দূর্বল; কর্তাব্যক্তির ভুল সিদ্ধান্তে হ্যাঁ ও প্রশংসাসূচক বাক্য বলার মধ্য দিয়ে নিজের চেয়ারে দখলদারিত্ব ধরে রাখতে তৎপর থাকে। তারা রাতকে রাত ও দিনকে দিন বলার সাহস রাখে না। সুতরাং তৈল গ্রহণকারী ব্যক্তির তেলবাজদের বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরী। কারণ তেলবাজ নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ আদায়ে সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের বড় ক্ষতি করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এমনকি কর্তাব্যক্তির চেয়ারচ্যুতি হলে ওই তেলবাজরাই কর্তাব্যক্তির বিরুদ্ধে চিৎকার করে গলা ফাটায়। চেয়ারে নতুন আগত কর্তার পিছনে ঘুরে ঘুরে জুতো ক্ষয় ও তেললেপন করে আস্থাভাজনে পরিণত হয়।
তেলবাজদের ক্ষমতার চারপাশে অবাধ বিচরণ করতে দেখা যায়। তেলবাজের সমার্থক শব্দ পদলেহন এখানে যথোপোযুক্ত। প্রয়োজন পড়লে কর্তাব্যক্তির পা চাটতেও তেলবাজরা দ্বিধাবোধ করে না। নিজেদের স্বার্থে এরা সূচ হয়ে প্রবেশ করে ফাল হয়ে বের হতে পারে। তেলবাজিতে তিনিই সিদ্ধহস্ত, যিনি জায়গা মতো তেল মারতে পারেন। তেলবাজদের কর্মে দক্ষতা নেই কিন্তু কর্তাব্যক্তিকে দেখাতে চায় যে তারাই দক্ষ-অভিজ্ঞ, সৎ, বিশ্বস্থ ও প্রীতিভাজন; মুখের ভাষা দিয়ে দেখাতে চায় যে তার চেয়ে বড় শুভাকাঙ্খী আর দ্বিতীয়টি নেই। তেলবাজদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- উপঢৌকন বা পারিতোষিক প্রদর্শন। নেক নজরে থাকবার জন্য কর্তাব্যক্তিকে কিভাবে তুষ্ট করা যায় তেলবাজ তা ভালোভাবে জানে। কারণ তেলবাজরা জানে যে, গোমড় ফাঁস হয়ে গদি হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা ওয়ান টুর ব্যাপার। সুতরাং দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখাই বরং বুদ্ধিমানের কাজ। তেলবাজরা দু’মুখো সাপের মতো। একমুখ দিয়ে কর্তার সামনে স্তুতিবাক্য উগলে দেয় আবার কর্তাব্যক্তির অনুপস্থিতিতে আরেক মুখ দিয়ে বিষবাক্য উদগিরণ করে।
সমাজে তেল মারা লোকের অভাব নেই। কে, কাকে কতটুকু তেল মেরে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করবে, স্বার্থসিদ্ধি করবে, নেক নজরে আসবে তা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। অনেক ক্ষেত্রে যাকে তেল মারা হয় সেও এতে খুব খুশি হয়। এই ধরণের তেলবাজদের কারণেই দেশ, সমাজ, সম্প্রদায়, প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের পথে যায়। কারণ তেলবাজরা সত্যকে সত্য বলতে সাহস পায় না বরং তেল মারাটাকেই সত্য ও নৈতিক কর্ম ভাবে। আর সে জন্যই নিজেকে তেলের বিশাল বিশাল আধার করে গড়ে তুলতে দিনরাত প্রাণান্ত প্রচেষ্টা।
ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা, সিএসসি নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন বলতেন, আমাকে কলেজ ছাত্রের অভিভাবকরা কত ধরণের বিদেশী ক্রিম এনে দেয়। আমি সেগুলো মাখি না; বরং আমার সরিষার তেল আছে। দু’হাতে ঢলা দিয়ে তাই মুখে মাখি। কই কোন দিন তো আমার মুখয়োব ফাটেনি। তেলবাজদের হয়েছে ভিন্ন দশা। নিজেরা নিজেদের তেললেপন করা বাদ দিয়ে সর্বোৎকৃষ্ট জায়গায় কিভাবে তেলের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায় তাই নিয়ে চিন্তিত। তেললেপন করে একেকজনের শরীরের চামড়া তুলে ফেললেও ক্ষান্ত হয় না। উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত খুঁজতে থাকে কার পদে তেললেপন করা যায়। দেশের সর্বত্র তাকালে বোঝা যায়, যে যত বেশী তৈলবিদ্যা আয়ত্ত করতে পেরেছে সে জীবনে ততবেশী উন্নতি করেছে। মনে হয় তেলবিহীন বিদ্যা ফুটো পয়সার মতো যেন অচল। তেলবাজির তেলসমাতি আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও বহাল তবিয়তে থাকবে। তবে তেলবাজিদের কাছ থেকে সব সময় সাবধান থাকতে হবে। অযথা যখন কেউ প্রশংসার ফুলঝুড়ি ছড়ায় তখনই বুঝে নেওয়া উচিত ‘দেয়ার ইজ সামথিং রং’। বরং যিশুর শিক্ষানুযায়ী নিজেদের গড়ে তুলা উচিত, “সেই বুদ্ধিমান লোক যে পাথরের ওপর নিজের ঘর গড়ে তুলেছে। বৃষ্টি হলো, বন্যা এলো, বাতাস বইলো, বাড়িটার ওপর আছড়ে পড়লো কিন্তু বাড়িটা ভেঙ্গে পড়লো না”।