ফাদার দিলীপ এস. কস্তা                                                                                                                    

০৭. মিল সাধনা: একটি অসমাপ্ত যাত্রা

মানুষের জীবনের মৌলিক সাধনা হলো ‘মিলন’। সেই মিলন হলো ঈশ্বর-মানুষে, মানুষে-মানুষে এবং মানুষ ও বিশ্ব প্রকৃতির সাথে। বাউল মুণি-ঋষিদের একান্ত প্রার্থনা ও প্রচেষ্টা প্রকাশ করেছে গানের মধ্য দিয়ে ‘মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষের সনে’। উপাসনা সঙ্গীতে গাওয়া হয় “মিলনের তরে কাপিছে হিয়া এসো এসো প্রিয় হে”। মিলন সাধনা একটি আমরণকালের প্রচেষ্টা ও প্রক্রিয়া যাকে আমরা অসমাপ্ত যাত্রা বলতে পারি। আর সেই যাত্রা জীবন স্রষ্টা ঈশ্বরের দিকে।

এই পৃথিবীতে বসবাসের জন্য নানা ধরনের বৈরী বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায়। অসম এই বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য, জাতিগত বিভেদ-বৈষম্য, ধনী-গরীবের মধ্যে বৈষম্যসহ আরো অনেক কিছু। মানুষের স্বার্থপরতা, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, লোভ, স্বার্থন্বেষী মনোভাব, উচ্চ আকাঙ্খা, ভোগ- বিলাসীতা, অলসতা আরাম প্রিয়তা ইত্যাদির কারণে মিলন সাধনার পথ থেকে মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে। তবে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের আকাঙ্খা ও প্রার্থনা হলো ‘মিলন ও শান্তি’।

খ্রিস্টমণ্ডলী এক ও অভিন্ন এবং এর বৈশিষ্ট্য হলো মণ্ডলী এক (One), মণ্ডলী পবিত্র (Holy), মণ্ডলী কাথলিক (Catholic) এবং প্রৈরিতিক (Apostolic)। সত্য ও সনাতন কাথলিক মণ্ডলী স্বয়ং যিশু খ্রিস্ট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত (দ্রষ্টব্য মথি ১৬: ১৬-১৯)। সুতরাং দেহরূপ মণ্ডলী হলো এক এবং এর শিক্ষাও এক। দীক্ষার গুণে আমরা ভক্তবিশ্বাসী এক মণ্ডলীর সদস্য হয়ে মিলন একতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তুলতে আহূত। মিলনের এই যাত্রা পথে আমাদের পরিচয় হলো পারস্পরিক ভালবাসা ও ক্ষমার। সাধু পল তার শিক্ষার মধ্যে আমাদেরকে আহ্বান করেন এক মণ্ডলীর সদস্য হয়ে এক খ্রিস্টের ছত্রছায়ায় জীবন যাপন করতে। “তোমাদের আহ্বান ক’রে পরমেশ্বর তোমাদের সকলেই সামনে যে-আশা তুলে ধরেছেন, সেই আশা যেমন এক, তেমনি খ্রিস্টের সেই দেহটিও  এক আর পবিত্র আত্মাও এক; প্রভু এক খ্রিস্টবিশ্বাসও এক, দীক্ষাস্নানও এক; সকলের ঈশ্বর দেহটিও পিতা, সবার ঊর্ধ্বে আছেন যিনি, যিনি সবার মধ্য দিয়ে সক্রিয়, সবার মধ্যেই বিদ্যমান” (এফেসীয়: ৪:৪-৬)।

০৮. মিলন সাধনার অর্থ বা তাৎপর্য

গ্রীক শব্দ Kainonia এবং ল্যাতিন শব্দ Communio থেকে ইংরেজী Communion শব্দটির উদ্ভব। Communion শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো মিলন, একতা। মিলন শব্দটি ইতিবাচক অর্থ প্রকাশ করে। সমার্থক শব্দ হলো সংযোগ সম্মেলন, পুনর্মিলন, মিলনান্তক ইত্যাদি। মিলনের বিশেষ অর্থ হলো যারা একটি দেয়াল ঘেরা স্থানে বা একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক স্থানে পারস্পরিক কল্যাণের জন্য বসবাস করে। এই অর্থেই মণ্ডলী একটি সংস্কারীয় বা কল্যাণকারী সমাজে বা সামাজিক সংস্কার।

নতুন নিয়মে সাধু পল মণ্ডলীকে তুলনা করেছেন খ্রিস্টের দেহরূপে। তাঁর মতে ‘কইনোনিয়া’ হলো সেই সব মানুষের সমাজে যারা একই প্রকার বাস্তবতা বা অবস্থার মধ্যে বসবাস করে (১ করি: ১০: ১৫-১৭; ১২: ১২, ২৬-২৭)। তবে মাণ্ডলীক ‘কমুনিয়ন’ কোন সামাজিক বা  গণতান্ত্রিক ভিত্তির উপর নয় বরং ঐশতাত্ত্বিক ভিত্তির উপর স্থাপিত। এর ফলে মণ্ডলীর প্রতিটি সদস্য খ্রিস্টদেহ গ্রহণ করে অর্থাৎ খ্রিস্টের জীবনে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে সেই দেহের অংশী হয়ে ওঠে যার মস্তক হলেন স্বয়ং খ্রিস্ট সেই দেহের চালিকাশক্তি হলো ‘পবিত্র আত্মা’ মণ্ডলীতে এই মিলন পূর্ণভাবে রূপায়িত হয় পবিত্র খ্রিস্টযাগে বা রুটিভাঙ্গার অনুষ্ঠানে। খ্রিস্টপ্রসাদের পুণ্যভোজ গ্রহণ করে যাজক ও খ্রিস্টবিশ্বাসীরা হয়ে ওঠে ‘এক রুটি ও এক দেহ’- সেই জীবন্ত দেহ যার মস্তক স্বয়ং খ্রিস্ট।

০৯. মিলন সাধনার কয়েকটি দিক

বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে কেহই একা নয় বিভিন্নভাবে মানুষ মিলন সমাজ গড়ে তোলে পৃথিবী যেমন একটি মিলন ক্ষেত্র তেমনি বিশ্বাসী মানুষের জীবনে চূড়ান্ত মিলন হলো জীবন-স্বামী ঈশ্বরের সাথে। মিলন সাধনার জন্যই পারিবারিক জীবন, পরিবার, ধর্মীয় ও ব্রতীয় জীবন টিকে থাকে। মিলন সাধানার কয়েকটি চিন্তা নিম্নে তুলে ধরা হলো:

জীবন স্রষ্টা ঈশ্বরের সাথে মিলন: সব মানুষেরই চূড়ান্ত লক্ষ্য বা ইচ্ছা হলো ঈশ্বরের সাথে মিলন। সাধু আগষ্টিন বলেন “আমাদের অস্থির সত্ত্বা যতক্ষণ না তোমাতে মিলিত হয় ততক্ষণ তা শান্ত হয় না”। বিশ্বাসী মানুষের মিলন হলো ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা। পার্থিব জীবন হলো ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের প্রস্তুতি ক্ষেত্র। আমাদের সৎ প্রচষ্টা ও ধার্মিক হবার একান্ত ইচ্ছার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সাথে মিলিত হওয়া সম্ভব।

নিজ ব্যক্তি সত্ত্বার সাথে মিলন: মুখোশের আড়ালে মুখ নামক বইয়ের মধ্যে বলা হয়েছে ‘আমি কেন নিজের আসল সত্ত্বাকে প্রকাশ করতে ভয় পাই?’ অর্থাৎ আমরা অনেকেই দুই স্বভাবের মানুষ (Double Face) বাইরের আমি ও ভিতরের আমি এক হয়ে ওঠেনা। সে কারণেই ব্যক্তি সত্ত্বার বাইরের ও ভিতরের স্বরূপ এক হওয়া কতই না জরুরী বিষয়। একরুপ, এক বিশ্বাস ও এক হয়ে জীবন যাপন করা।

আন্তব্যক্তিক সম্পর্ক: মানুষ সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক (Rational) প্রাণী। ব্যক্তি মানুষ মাত্রই কোন না কোন সভ্য সমাজের সদস্য। ইংরেজী প্রবাদতুল্য বাণী হলো No man is an Island অর্থাৎ আমরা কেউই নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা নই। সমাজের সাথে মিলে মিশে থাকা এবং একসাথে পথ চলা ও কাজ করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিরই একটি দিক। আন্তব্যক্তি মিলন ও অন্যকে গ্রহণ করা। ব্যক্তিকে মর্যাদা দেওয়া এবং আমরা প্রত্যেকেই যে সতন্ত্র কিন্তু গ্রহণ করার মাধ্যমেই মিলন হওয়া সম্ভব। বৃহত্তর স্বার্থে ও কল্যাণ মনে না মিলেও মেনে নিতে হবে।

প্রতিবেশীর সাথে মিলন: নিকটতম জনবসতি ও মানুষের সাথে প্রেমপূর্ণ সম্পর্ক ও বন্ধুত বজায় রেখে জীবন যাপন করা একটি কঠিন কাজ বা চ্যালেঞ্জপূর্ণ বাস্তবতা। বিশেষভাবে গ্রাম অঞ্চলে প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কের ফাটল ধরে ছোট খাটো বিষয় ও জিনিস নিয়ে। পারিবারিকভাবে সহায় সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব-বিরোধেরও শেষ নেই। পরিবার থেকে শুরু করে দেশ ও জাতির মধ্যেও দ্বন্দ্ব কোলাহল যুদ্ধ-বিগ্রহ বেড়েই চলছে। বৈরী এই বাস্তবতার মধ্যে মিলন ও একতার বন্ধন দৃঢ় করা কঠিন একটি বাস্তবতা।

আমাদের নিরন্তন প্রচেষ্টা, প্রার্থনা ও পারিবারিক পরিসরে শান্তি ও মিলন স্থাপনের সাধনা অব্যাহত রাখতে হবে। যিশু নিজেই বলেছেন “সেই সহায়ক, সেই পবিত্র আত্মা, যাকে পিতা আমার নামে পাঠাবেন, তিনি তোমাদের সব কিছুই শিখিয়ে দেবেন এবং যা কিছু আমি তোমাদের বলে গেলাম, সেই সমস্তই তিনি তোমাদের মনে  করিয়ে দেবেন” (যোহন ১৪:১৬)। সেই পরম সহায়ক পবিত্র আত্মাই আমাদেরকে একতা ও মিলনের পথে চলতে সহায়তা দান করবেন।

প্রতিবেশ/পরিবেশের সাথে সম্পর্ক: বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে রয়েছে গাছ-পালা, পাহাড়-পর্বত, কীট-পতঙ্গ, নদী-নালা, জীব-জন্তু ইত্যাদি। তবে সবকিছুর উর্ধ্বে মানুষ। মানুষ তার বুদ্ধিসত্ত্বা দিয়ে বিশ্ব প্রকৃতির উপর রাজত্ব করছে। মানুষের মানবিক  ও নৈতিক দায়িত্ব হলো বিশ্ব প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা। মানুষ ও বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে যেন শান্তিপূর্ণ ও মিলনের বাস্তবতা বিরাজ করে সেই প্রচেষ্টা সবার মধ্যেই যেন স্থান পায়। পোপ ফ্রান্সিস তাঁর Laudato Si নামক পালকীয় পত্রের মাধ্যমে সবাইকে পরিবেশ বান্ধব  মানুষ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বাসযোগ্য ও শুদ্ধ সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ বাস্তবতা ও বিশ্বপ্রকৃতির সাথে মিলে মিশে বসবাস করা সম্ভব।

খ্রিস্টবিশ্বাসী ও ধর্মপল্লীর সাথে মিলন: ধর্মপল্লী হলো মিলন সমাজ গড়ে তোলার অন্যতম একটি ক্ষেত্র। সার্বজনীন মণ্ডলীর ‘ক্ষুদ্র কোষ’ হলো ধর্মপল্লী তবে শিক্ষা-দীক্ষার মধ্য দিয়ে বিশ্বমণ্ডলীর সাথে ক্ষুদ্র মণ্ডলী মিলিত হয়। এ যেন অতুল প্রসাদ সেনের (১৮৭১-১৯৩৪) একান্ত চাওয়া এবং আমাদের হৃদয়ের প্রার্থনা ‘‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’।

সংহতি অন্তর্ভুক্তি: সিনোডাল মণ্ডলীর অন্যতম শিক্ষা ও আহ্বান হলো সবাইকে মণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত করে এক সাথে পথ চলা। সংহতি হলো বিশ্বমণ্ডলীর তথা স্থানীয় মণ্ডলীর সাথে একাত্ম হওয়া। মানুষের হৃদয় হলো ভালবাসার জমিন যেখানে স্থান পেতে পারে সকলেই। কেননা ঐশরাজ্যে নিমন্ত্রণ সকলের জন্যই উন্মুক্ত কিন্তু আপন আপন দায়িত্ব বিশ্বস্তভাবে পালন করার মাধ্যমে। বিভিন্ন ধর্মসংঘের সদস্য রয়েছি আমরা তাই আপন আপন কার্যক্রম ও প্রথা ও প্রত্যেকে কর্ম করে মিলনের প্রচেষ্টা নিয়ে কাজ করতে হবে।

সংলাপের সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হওয়া: সংলাপ হলো একটি চলমান প্রক্রিয়া যা অনুশীলন করার মাধ্যমে বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, মিলন ও একতা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে খ্রিস্টানদের পরিচিতি খুবই কম। দৈনন্দিন জীবনে কাজ কর্ম, যোগাযোগ, দেখা সাক্ষাৎ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে হয়ে থাকে এবং ইচ্ছা অনিচ্ছায় তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে হয়। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপ কমিশন রয়েছে তবে জীবন ভিত্তিক সংলাপই হলো আসল কথা। তাই সংলাপ একটি কার্যকরী পদক্ষেপ যার মধ্য দিয়ে মিলন -একতা, বন্ধুত্বও সুসম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হয়। আমরা এক কথায় বলতে পারি সংলাপের সংস্কৃতি গড়ে তুলি এবং তা অনুশীলনের মধ্য দিয়ে মিলন সাধনায় নিবিষ্ট হই।

পিতার গৃহে মিলন উৎসব: খ্রিস্টযাগের জন্য (দ্রষ্টব্য: মথি ২৬:২৬-২৯; মার্ক ১৪: ২২-২৫; ১ম করি: ১১:২৩-২৬) সকলে একত্রে মিলিত হওয়া, প্রভুর ভোজে আধ্যত্মিক প্রস্তুতি মাধ্যমে মিলন হওয়া। প্রার্থনা, প্রশংসা ধন্যবাদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ এক বিশ্বাস, এক মণ্ডলী ও নীতিতে মিলিত হয়ে পথ চলা।

আভিলার সাধ্বী (১৫১৫১৫৮২) তেরেজার মিলন পথ

কাথলিক ধর্মসংঘের সদস্য অভিলার সাধ্বী তেরেজা মিলন সাধনার যে পথ রচনা করেছেন তা যাজক ও ব্রতীয় জীবনে অনুসরণ ও অনুকরণ করার মতো অন্যন্য একটি। তবে তা কঠোর সাধনার ত্যাগ ও কৃচ্ছতার পথ। পরম প্রাসাদ, আত্মার সপ্ত মহল (The Interior Castle of The Mention) তিনি বলেন, “ঈশ্বর মানুষের অন্তরে বাস করেন তার সঙ্গে মিলিত হতে গেলে ধ্যান করতে হয়। ধ্যান অন্তরের পরম প্রাসাদ উন্মুক্ত কর। ধ্যান সাধনার ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের শেষে সপ্তমে ঈশ্বরের আত্মিক পরিচয় বা মিলন ঘটে”। মরমিয়া আভিলার সাধ্বী তেরেজা অভিজ্ঞতার “জাগতিক আনন্দ ও মিলনের শেষ যেখানে -সেখানেই শুরু হয় আত্মিক মিলন আনন্দে”। নিবেদিত ও যাজকীয় জীবনের অন্যতম সাধনা হলো ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ তথা ঈশ্বরের সাথে মিলন।

 “কাথলিক সন্ন্যাসজীবনের ইতিহাসে টেরেজার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিশ্বদরবারে কিন্তু তাঁর গুরুত্ব আধ্যাত্মিক জগতেই, মরমিয়া সাধনার ক্ষেত্রে। তাঁর সংস্কারান্দোলন যতটা সফল হয়েছে, তাঁর লেখাগুলি তার চেয়ে আরও বেশী সাফল্য লাভ করেছে। ধ্যান সাধনার ক্রমগুলির বর্ণনায় আজ পর্যন্ত কেউ সাধ্বী তেরেজা সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি; বলা বাহুল্য তাঁকে কেউ ছাড়িয়েও যায়নি। বলতে গেলে, তাঁর জীবনকাল থেকে সমস্ত আধ্যাত্মিক লেখক কম বেশী তাঁর লেখা থেকে প্রভাবিত হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম সাধু ফ্রান্সিস দ্য সেল” (উৎস: পরম প্রাসাদ, আভিলার সাধ্বী টেরেজা, পৃষ্টা ১১)।

বিশ্বের সকল সৃষ্টি এবং মিলনের মধ্যে পূর্ণতা ও আনন্দ। বাহ্যিক বা দৈহিকভাবে মিলনের মাধ্যমে নতুন সৃষ্টি শুরু অন্যদিকে আধ্যাত্মিক মিলনের মাধ্যমে জীবনের পূর্ণতা তাই আমাদের আহ্বান হলো ‘মিলাবে মিলিবে’।

 () মিলন সাধনার যাত্রা, আধ্যাত্মিক বৈষয়িক বাস্তবতার দিকে

আধ্যাত্মিক যাত্রা হলো সর্বদাই ঈশ্বরমুখ। ঈশ্বরের জন্যই আমাদের জীবন কর্ম ও সকল সাধনা। বৈষয়িক মিলন বিশ্ব সংসারের স্থাবর-অস্থাবর সবকিছুর। গোটা বিশ্ব সৃষ্টির একটি অন্যটির সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং নির্ভরশীল বটে। পারস্পরিক সম্পর্ক ও নির্ভরশীল জন্যই বিশ্বসৃষ্টির সজীব ও প্রাণবন্ত থাকে। সংযুক্তি ও মিলন সাধনা সবার সাথে। আধুনিক ইমেলের (Attached) ফাইলের যা একজনের কাছ থেকে অনেকজনকে দেওয়া যায়। অন্যদিকে, বিচ্ছেদ হলো জগতের জাগতিকতা থেকে আলাদা হওয়া অর্থাৎ (Dedutched)। জগত থেকে আলাদা বিছিন্নতা হওয়া অর্থাৎ জাগতিক বিষয়াদি আরাম আয়েশের জীবন পরিত্যাগ, ত্যাগ ও কৃচ্ছতার জীবন যাপন করা। জগত থেকে পালিয়ে যাওয়া (Fuga Mundi) নয় কিন্তু জগতে থেকে আধ্যাত্মিক চেতনা নিয়ে আনন্দে জীবন যাপন করা এবং সমাজ, মানুষ ও প্রকৃতির সাথে মিলন সাধনা রত থাকা।

() নিবেদিত জীবনে পূর্ণতা আনন্দ অনুভবে

নিবেদিত জীবনের আনন্দ হলো নিঃশর্তভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে ব্যক্তি জীবনে গ্রহণ করা এছাড়া সংঘবদ্ধ জীবনের বাস্তবতাকে ঈশ্বরের পরিকল্পনা হিসেবে গ্রহণ করা। আনন্দময় জীবন হলো সবকিছু সন্তুষ্টি মনে গ্রহণ করা এবং বিশ্বস্ত থাকা। পুণ্য পিতা পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “আমি তোমাদের একটি কথাই বলতে চাই এবং তা ‘আনন্দ’। যেখানে রয়েছে উৎসর্গীকৃত  মানুষ, পুরোহিত, সন্ন্যাসব্রতী নর-নারী, যুব সেখানেই রয়েছে আনন্দ। সেখানে সর্বদা থাকে আনন্দ। এই আনন্দ সজীবতার আনন্দ। যিশুকে অনুসরণ করার আনন্দ। যে আনন্দ জগতে দিতে পারে না বরং পবিত্র আত্মা দান করে”।

পোপ ফ্রান্সিস আরো বলেন, “দুঃখের মধ্যে কোন পবিত্রতা নেই। তাই যাদের আশা নেই তাদের মতো তোমরা দুঃখ করো না। তিনি আরও বলেন-“আনন্দ কোন অকেজো গায়না নয়। ইহা হচ্ছে একটি প্রয়োজন, মানব জাতির ভিত্তি”।

আনন্দময় জীবন উপলদ্ধি বিষয়ে পোপ ফ্রান্সিসের বাণী হলো, “সংঘবদ্ধ জীবনের অভিজ্ঞতাই আনন্দকে সুদৃঢ় করে, সেই ঐশতাত্ত্বিক অবস্থা বা স্থান যেখানে প্রতিজনই মঙ্গলবাণীর প্রতি নিজেদের বিশ্বস্ততা ও অন্য সকলের বেড়ে ওঠার জন্য দায়িত্বশীল”। তিনি আর  বলেন, “সংঘবদ্ধ জীবনে সব সময়ই থাকে একটি মহৎ হৃদয়। কোন কিছু ধরে রেখো না, বড়াই করো না, সকল কিছুর সাথে ধৈর্য ধর, অন্তর থেকে হেসে উঠা। আর এর চিহ্ন হলো আনন্দ”।

১০. মিলন সাধনা: পরিবার, সমাজ মণ্ডলী বিভিন্ন ধর্মসংঘ

পরিবার সমাজের প্রাণকেন্দ্র। বর্তমান বাস্তবতায় যৌথ পরিবার নেই বলেই চলে। পরিবার যেমন সুখের ঠিকানা অন্যদিকে পরিবারের মধ্যে অসম বাস্তবতা বিরাজ করে। বিশপ জের্ভাস রোজারিও’র পালকীয় পত্রে পরিবারে বাস্তবতার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তা হলো: ‘‘পরিবারে অমিল, শীতল সম্পর্ক, শিথিলতা, অনৈতিকতা, বহুগামিতা, অনাদর্শিক চর্চা। নেশাগ্রস্থতা, অলসতা, অর্থনৈতিক দুষ্টাচার, আয়-ব্যয় অপরিণামদর্শিতা, অশুভ প্রতিযোগিতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি, পড়াশুনায় অমনোযোগিতা, পারিবারিক সহিংসতা, ভোগবাদ, প্রান্তিক মানুষের প্রতি অযত্ন, অবেহেলা, অমর্যাদা, ধর্মীয় বিশ্বাস, শিক্ষা ও অনুশীলনে উদাসীনতা, উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক মন্দ প্রভাব আমাদের আক্রান্ত করে রেখেছে। এইসব কারণে পরিবারে মিলনের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে’।

একনজরে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পরিচিতি। ২৫টি ধর্মপল্লী বিভিন্ন ধর্মসংঘের ফাদার (ধর্মপ্রদেশ, হলিক্রশ, পিমে, জেজুইট, সালেসিয়ান ও অবলেট) সিস্টার (শান্তিরাণী, হলিক্রশ, পিমে, সালেসিয়ান, এসএমআরএ, আরএনডিএম, এলএইসসি, লুইজিনা ও এলএস) ও হলিক্রশ ব্রাদার সংঘ। ধর্মপ্রদেশ প্রদেশের, যাজক-ব্রাদার ও সিস্টাদের কর্মক্ষেত্রে হলো ধর্মপল্লী, স্কুল, কলেজ, ডিসপেন্সারী, গঠনগৃহ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদি। কাজের ভিন্নতা রয়েছে বটে কিন্তু একই স্রষ্টার সাক্ষ্য দান করা একাই মঙ্গলবাণীর অনুসরণ করা।

প্রত্যেকটি ধর্মপল্লীই ধর্মপ্রদেশের একটি অংশ এবং ধর্মপ্রদেশ বিশ্ব কাথলিক মণ্ডলীর অংশ এবং বিশ্ব কাথলিক মণ্ডলীর সাথে একাত্ত্বতা প্রকাশ করে। দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভা (১৯৬২-১৯৬৫) মণ্ডলীতে ‘বিশপদের পালকীয় কার্যাবলী’ বিষয়ক নির্দেশনামায় বলা হয়েছে, “একটি ধর্মপ্রদেশ ঐশজনগণের একটি অংশ। একজন বিশপের অধীনে তা ন্যাস্ত করা হয়েছে। তিনি তার যাজকমণ্ডলীর সহায়তায় তা পরিচালনা করেন যেন এর পালকের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে এবং খ্রিস্টপ্রসাদ ও মঙ্গলসমাচারের মাধ্যমে পবিত্র আত্মায় একটি সমাজ গঠিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট মণ্ডলী গড়ে উঠে যেখানে খ্রিস্টের এক, পবিত্র, কাথলিক (সার্বজনীন) ও প্রৈরিতিক মণ্ডলী সত্যিই উপস্থিত ও সক্রিয়” (ধারা নং ১১)।

এছাড়া ‘খ্রিস্টমণ্ডলী’ বিষয়ক সংবিধান ধর্মপল্লী বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘‘পালকদের সাথে সংযুক্ত থেকে এবং আইনগতভাবে সংগঠিত খ্রিস্টবিশ্বাসীদের যে কোন সমাজ খ্রিস্টের মণ্ডলী বাস্তবে উপস্থিত থাকে। আর বিশ্বাসীদের সেই সমাজগুলো যথার্থভাবেই নতুন নিয়মে বর্ণিত মণ্ডলীগুলোর অনুরূপ হয়ে উঠে (শিষ্যচরিত ৮: ১;১৪: ২২-২৩, ২০:১৭)’’ [ধারা  নং ২৬] একটি ধর্মপল্লীর ৪টি মৌলিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত। আর তা হলো:

১. পালকের মধ্য দিয়ে ধর্মপ্রদেশের সাথে ধর্মপল্লীতে সংযুক্ত থাকা ও মিলন যাজক গড়ে তুলে।

২. বিশপের সাথে পালকের সম্পর্ক রাখা তার অনুগ্রহ ও স্বীকার ও সুসম্পর্ক বজায় রাখা।

৩. খ্রিস্ট বিশ্বাসীদের সাথে পালকের সম্পর্ক; এবং পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধন দৃঢ় রাখা।

৪. পালকের পালকীয় কাজের প্রতি যত্মশীল থাকা এবং মিলনের আনন্দ নিয়ে জীবন যাপন করা।

১১. কর্মক্ষেত্রের সবাইকে নিয়ে মিলন সাধনায় যাত্রা

বিশ্বাস ও দীক্ষার কারণে গোটা বিশ্বমণ্ডলী  একটি মিলন সমাজ অন্যদিকে স্থানীয় মণ্ডলী হলো মিলন সমাজ যেখানে আমরা মিলিত হয় উপাসনায় এবং ধর্মপল্লী বিভিন্ন সংঘ সমিতি ও অঙ্গ সংগঠনের মাধ্যমে। সাধু আগস্টিন (৩৫৪-৪৩০) বলেন “(খ্রিস্টযাগ) এ অনুষ্ঠান ভক্তি সংস্কার একতার চিহ্ন ও প্রেমের বন্ধন”। যিশু বলেন “কেননা যেখানে দু’ তিনজন আমার নামে একত্র হয়, আমি সেখানে তাদের মধ্যে আছি” (মথি ১৮:২০)।

আমাদের ধর্মপল্লীর  সংগঠন গুলো হলো: পালকীয় পরিষদ, ক্রেডিট ইউনিয়ন, এসভিপি, মা-মারীয়ার সংঘ, সেনা সংঘ, ডিসপেন্সারী, প্রভাত তারা, কাপিতানিও সংঘ, ছেলে ও মেয়েদের বোর্ডিং, যুব-সংগঠন, ছাত্রসংগঠন, বিসিএসএম, ওয়াইসিএসএম, সেবকদল, শিশুমঙ্গলসহ আরো গ্রামভিত্তিক সংগঠন রয়েছে। এছাড়া খ্রিস্টিয় লোকভক্তির বিভিন্ন দল গুলো হলো:  সাধু আন্তনীর পালা গান, কষ্টের গান, বৈঠকী গান, কবি গান, কীর্তন গান বিভিন্ন সাধু-সাধ্বী জীবন আলেখ্য রচিত, যাত্রা বা পালা গান।  এই সমস্ত সংঘ সমিতি ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মূল লক্ষ্য হলো একতা মিলন তথা একসাথে পথ চলা এক লক্ষে পৌঁছা।

মাতা-মণ্ডলী স্মরণ করিয়ে দেয় একসাথে পথ চলতে তথা সিনোডাল মণ্ডলী গড়ে তুলতে। মিলন সাধনার যাত্রা পথে কেউ বাদ না পড়ে বা অবহেলিত না হয়। যিশুর শিক্ষা হলো: “বরং আপনি যখন ভোজের আয়োজন করেন, তখন গরীব, পঙ্গু, খোঁড়া ও অন্ধদেরই নিমন্ত্রণ করুন; এতে আপনি সুখী হবেন, আপনাকে প্রতিদানে দেওয়ার মত তাদের কিছু নেই, তাই ধার্মিকদের পুনরুত্থানের সময়ে আপনি প্রতিদান পাবেন” (লুক: ১৪: ১৩-১৪)। মিলন সাধনার যাত্রা হলো নিঃস্বদের নিয়ে আর পিতা পরমেশ্বর অনুগ্রহে পূর্ণতা লাভ করে। ধর্মপল্লীর পর্বোসবের আধ্যাত্মিক অনুশীলন তীর্থ যাত্রা, ব্যক্তিগত ধ্যান-প্রার্থনা, মানত পূর্ণ বিষয়গুলোতে ও গুরুত্ব করতে হবে।

১২. আনন্দিত প্রাণ: নিবেদিত সকলে

মিলন সাধনায় ব্রতী হয়ে আমরা একসাথে বলি “সবারে করি আহ্বান, এসো উৎসুক চিত্তে, এসো আনন্দিত প্রাণ”। জীবনের অন্যতম একটি মূল্যবোধ হলো আনন্দে থাকা অর্থাৎ সন্তুষ্টি মনে জীবন যাপন করা। গোটা বিশ্ব মণ্ডলীই হলো একটি মিলন সমাজ। এই মিলন কার্যকরী হয় উপাসনার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক প্রার্থনা ও মঙ্গলকামনার মাধ্যমে। কাথলিক মণ্ডলীতে পদমর্যাদা অনুসারে (Hierarchy) সবাই বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে থাকে যা মিলনেরই প্রকাশ। এই কারণেই খ্রিস্টমণ্ডলী সার্বজনীন আবার স্থানীয়। স্থানীয় মণ্ডলী ধর্মপল্লীর সাথে সরাসরি যুক্ত এবং স্থানীয় মণ্ডলীও স্থানীয় বিশপের সাথে মিলন ও ভ্রাতৃপ্রেমের সমাজ গড়ে তোলে।

মিলন সাধনা: তথা সর্বজনীন মণ্ডলীর সাথে মিলন বন্ধন আরও দৃঢ় হয়ে উঠবে এটাই হবে সিনোডাল মণ্ডলীতে বাস করার অন্যতম প্রচেষ্টা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিক্ষার মধ্য দিয়ে আদি মণ্ডলীর বৈশিষ্ট্যের কথা ফিরে আসে। আদি মণ্ডলীর বৈশিষ্ট্য বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা আমাদের সবার মধ্যে অব্যাহত থাকুক। “প্রেরিতদূতেরা যা কিছু উপদেশ দিতেন, সকলে তা নিষ্ঠার সঙ্গে শুনতো: তারা মিলে মিশেই জীবন যাপন করত এবং নিয়মিতভাবেই রুটিভাঙ্গার অনুষ্ঠানে যোগ দিত। খ্রিস্টবিশ্বাসীরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ ছিল; তাদের সব কিছুই ছিল সকলের সম্পত্তি” (প্রেরিত ২: ৪২)।

‘মিলন সাধনা’একটি অসমাপ্ত যাত্রা যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে এবং আমরাও ঈশ্বর মানুষ বিশ্ব প্রকৃতির সাথে এক হওয়ার জন্য সচেষ্ট থাকব। জীবন স্রষ্টা ঈশ্বর মানুষ ও প্রকৃতির সাথে মিলনের তাগিদ নিয়ে আমরা সবাই একসাথে বলি ‘‘আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে, নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কি সত্ত্বে আমরা সবাই রাজা’।

সহায়ক গ্রন্থ

১. বিশপ জের্ভাস রোজারিও, পালকীয় পত্র,  ‘মিলন সাধনা: অন্তর্ভুক্তি ও সংহতি’ ২০২৪, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ।

২. ফাদার সুনীল ডানিয়েল রোজারিও রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপের পালকীয় পত্র ২০২৪ একটি পর্যালোচনা।

৩. Vita Consecrata, Pope John Paul II, (অনুবাদ: ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা, সি,এস. সি), উৎসর্গীকৃত জীবন, বাংলাদেশ সন্ন্যাসব্রতী সংঘ সম্মিলনী, সাভার, ১৯৯৮।

৪. পরম প্রাসাদ আত্মার সপ্ত মঙ্গল, অভিলার সাধ্বী টেরেজা, প্রভু যিশুর গীর্জা, কলকাতা, ১৯৯২।

৫. সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, প্রভু নিবেদন পর্ব, ২-৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: মিলন সাধনার শিরোনামে প্রবন্ধটি রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ পালকীয় কর্মশালা  ২০২৪, ১৩-১৪ সেপ্টেম্বর পঠিত করা হয়।  প্রবন্ধটি কিছুটা সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়।

Please follow and like us: