বিশপ জের্ভাস রোজারিও

পবিত্র বাইবেলের কয়েকজন নারী শুধু যে ইস্রায়েল জাতির ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন তা নয়, তাঁরা গোটা মানব জাতির ইতিহাসেই প্রভাব ফেলেছেন। তাদের মধ্যে ২০ জন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যাদের কয়েকজন ছিলেন সাধ্বী আর কয়েকজন ছিলেন তাঁদের বিপরীত। তাঁদের মধ্যে অল্প কয়েকজন ছিলেন রাণী, কিন্তু অন্যরা সকলেই ছিলেন সাধারণ নারী। কিন্তু বাইবেলের গল্পে তাঁদের মূল্যবান ভূমিকা ছিল। তাঁদের প্রত্যেকজনই তাঁদের বিশেষ ভূমিকার জন্য প্রখ্যাত ছিলেন, আর তাই আমরা এখনও তাঁদের স্মরণ করি।

১। হবা: ঈশ্বরের প্রথম সৃষ্ট নারী (আদি ২:২১-২৩)
হবা ছিলেন প্রথম নারী যাকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছিলেন প্রথম পুরুষ আদমের সঙ্গিনী ও সাহায্যকারিণী হিসাবে। এদেন বাগানে সব কিছু ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু যখন হবা শয়তানের কথা বিশ্বাস করে আদমকে প্রভাবিত করেছিল তখন তারা ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করে ভাল ও মন্দ বিষয়ক জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়েছিল। হবার শিক্ষাটি আমাদের জন্য মূল্যবান, ঈশ্বরকে বিশ্বাস করা যায়, শয়তানকে নয়; যখন আমরা স্বার্থপর হয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছার ওপর নিজেদের ইচ্ছাকে স্থান দেই তখন আমরা মন্দ হই বা মন্দ কাজ করি, পাপ করি।

২। সারা: ইহুদি জাতির মাতা (আদি ১১:২৯-৩২)
সারা ঈশ্বরের কাছ থেকে এক অনন্য সম্মান লাভ করেছিলেন। আব্রাহামের স্ত্রী হিসাবে তাঁর গর্ভজাত সন্তান থেকে ইহুদি জাতির উৎপত্তি হয়েছে, যে জাতির সন্তান ছিলেন জগতের ত্রাণকর্তা যিশু খ্রিস্ট। কিন্তু তাঁর ধৈর্য্যহীনতার কারনে তিনি আব্রহামকে প্ররোচিত করেছিলেন যেন তিনি মিশরীয় দাসী হাগারকে বিবাহ করেন (আদি ১৬:১-১৬) যার গর্ভে আব্রহামের সন্তান ইসমাইলের জন্ম হয়; এই কারণে আব্রহামের বংশধরদের মধ্যে একটি বিবাদ শুরু হয়, যার প্রভাব এখনও চলছে। অবশেষে ৯০ বছর বয়সে ঈশ্বরের দয়ায় আশ্চর্য্যজনকভাবে সারা ইসাহাককে জন্ম দেন। সারার কাছ থেকে আমরা শিখি যে ঈশ্বর যা প্রতিশ্রুতি দেন তা সব সময়ই পূর্ণ হয়, আর ঈশ্বর কাজ করেন তাঁর নিজের সময়েই।

৩। রেবেকা: ইসাহাকের প্রভাবশালী স্ত্রী (আদি ২৪:১৫-২৭)
বিয়ের পূর্বে ইসাহাকের স্ত্রী রেবেকা ছিলেন বন্ধ্যা নারী। ইসাহাক তাঁর স্ত্রীর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার পর তিনি সন্তান সম্ভবা হয়েছেন। পরে রেবেকা যমজ সন্তানের জন্ম দেন: এসাউ ও যাকোব; রেবেকা কিন্তু ছোট ছেলে যাকোবকে বেশী ভালবাসতেন। চালাকী করে রেবেকা এসাউ-এর পরিবর্তে যাকবকে বৃদ্ধ ইসাহাকের আশির্বাদ পাইয়ে দিয়েছিলেন। সারা’র মত রেবেকার কাজেও বিভেদ বয়ে এনেছিল। রেবেকা একজন বাধ্য স্ত্রী ও স্নেহময় মা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পক্ষপাতিত্ব এক মহাসংকট ডেকে এনেছিলো। ঈশ্বর কিন্তু মন্দ থেকেও ভাল কিছু করতে পারেন; রেবেকার ঘটনাই তার প্রমাণ।

৪। রাখেল: যাকোবের স্ত্রী ও যোসেফের মা (আদি ২৯: ৯-১৪)
রাখেল যাকোবের স্ত্রী হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর বাবা লাবান তাঁর বড় বোন লিয়াকে আগে বিয়ে করতে যাকোবকে প্ররোচনা ও বাধ্য করেছিলেন। যাকোব কিন্তু রাখেলকে বেশী ভালবাসতেন কারণ রাখেল ছিলেন বেশী সুন্দরী। রাখেলের ছেলেরা ইস্রায়েল জাতির বারো গোষ্ঠির প্রধান হয়েছিলেন। সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন যোসেফ, কারণ তিনি দুর্ভিক্ষের সময় ইস্রায়েল জাতিকে রক্ষা করেছিলেন। বেঞ্জামিনের গোষ্ঠি থেকে জন্ম হয়েছিল আদিমণ্ডলীর সর্বশ্রেষ্ঠ মিশনারী প্রেরিতদূত সাধু পলের। বিবাহিত দম্পতি হিসাবে রাখেল ও যাকোবের ভালবাসা ছিল ঈশ্বরের আশির্বাদ লাভের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

৫। লিয়া: যিনি প্রতারণার ফলে যাকোবের স্ত্রী হয়েছিলেন (আদি ২৯: ৯-১৪)
লাবান চালাকী করে লিয়াকে যাকোবের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। যাকোব সাত বছর ধরে চেষ্টা করে রাখেলের মন জয় করে তাঁকে বিয়ে করতে পেরেছিলেন। বিয়ের রাত্রে লাবান রাখেলের বদলে লিয়াকে যাকোবের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর যাকোব আরও সাত বছর লাবানের বাড়ীতে কাজ করেছিলেন যেন লিয়াকে বিয়ে করতে পারেন। লিয়া ভগ্ন হৃদয় নিয়ে যাকোবের ভালবাসা অর্জন করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন, কিন্তু ঈশ্বর তাঁকে বিশেষভাবে আশির্বাদ করেছিলেন। লিয়ার সন্তান যুদার গোষ্ঠি থেকে জগৎত্রাতা যিশুখ্রিস্টের জন্ম হয়েছিল। লিয়া হলেন সেইসব মানুষের আদর্শ যারা ঈশ্বরের ভালবাসা অর্জনের আপ্রাণ চেষ্টা করে যান।

৬। যোসেবেদ: মোশীর মা (যাত্রা ২: ১-১০; ৬: ২০)
মোশীর মা যোসেবেদ ঈশ্বরের ইচ্ছা মেনে নিয়েছিলেন আর এইভাবে ইতিহাসের উপর বড় প্রভাব ফেলেছিলেন। যখন মিশরের অধিপতি ফারাউনের নির্দেশে মিশরীয়রা হিব্রু (ইস্রায়েলীয়) শিশুদের হত্যা করা আরম্ভ করে, তখন যোসেবেদ শিশু মোশীকে নলখাগড়ায় তৈরী করা একটি ঝাঁপিতে রেখে নীল নদের কূলে নলখাগড়ার মধ্যে লুকিয়ে রাখল। ফারাউনের কন্যা শিশুটিকে পেয়ে নিজের সন্তানের মত মানুষ করেছিলেন। যোসেবেদ পরে মোশীকে লালন পালন করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। মোশী তাই একজন মিশরীয়ের মতই বেড়ে উঠেছিলেন। ঈশ্বর তাঁকেই বেঁছে নিয়েছিলেন মিশরের দাসত্ব থেকে ইস্রায়েল জাতিকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে। ঈশ্বরের উপর যোসেবেদের বিশ্বাসই মোশীকে রক্ষা করেছিল, যেন তিনি ইস্রায়েল জাতির এক মহান প্রবক্তা ও আইন প্রণেতা হয়ে উঠতে পারেন।

৭। মিরিয়াম: মোশীর বোন (যাত্রা ২: ১-১০; ৬: ২০; গণনা ১২:১০)
মোশীর বোন মিরিয়াম ইস্রায়েল জাতিকে মিশর থেকে মুক্ত করে আনতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন; কিন্তু তাঁর অহঙ্কার তাঁর বিপদ ডেকে আনে। যখন শিশু মোশীকে যোসেবেদ নীল নদের নলখাগড়ার মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন, তখন ফারাউনের কন্যাকে বলে মিরিয়াম তাঁদের মা যোসেবেদকে তার কাছে নিয়ে এসছিলেন যেন মোশীর লালন পালনের ভার তাঁকে দেওয়া হয়। পরে যখন ইস্রায়েলীরা লোহিত সাগর পাড় হয়ে আসে, তখন আনন্দ উৎসবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মিরিয়াম। কিন্তু প্রবক্তা হিসাবে তিনি মোশীর কুশীয় স্ত্রীর বিষয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন। ঈশ্বর তাঁকে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত করে শাস্তি দিয়েছিলেন; ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে মোশী তাঁকে সারিয়ে তুলেছিলেন।

৮। রাহাব: যিশুর সম্ভাব্য পূর্বপুরুষ (যশুয়া ২ ও ৬ অধ্যায়)
যেরিখো শহরে একজন বারবনিতা বা দেহপসারিনী ছিলেন রাহাব। হিব্রু বা ইব্রিয়রা যখন কানান দেশ জয় করতে শুরু করেন, তখন হিব্রুদের গুপ্তচরদের তিনি তাঁর বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলেন; বিনিময়ে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। রাহাব সত্য ঈশ্বরকে চিনতে পেরেছিলেন। তাই যখন ইস্রায়েলীদের হাতে যেরিখোর পতন হয় তখন ইস্রায়েলীয় সৈন্যরা তাদের কথা রেখেছিল; তারা রাহাবের বাড়িটি নিরাপদ রেখেছিল। রাহাব ছিলেন রাজা দাউদের সম্ভাব্য পূর্বপুরুষ; আর রাজা দাউদের বংশে জন্ম নিয়েছিলেন যিশু।

৯। দেবোরাহ্: প্রভাবশালী নারী বিচারক (বিচারক ৪: ৪-৫)
দেবোরাহ ইস্রায়েলের ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন; ইস্রায়েল দেশের ইতিহাসে প্রথম রাজা পাওয়ার আগে দেবোরাহ ছিলেন একমাত্র মহিলা সেনাপতি, প্রবক্তা ও বিচারক। পুরুষ শাসিত সমাজে তিনি একজন প্রবল শক্তিধর যোদ্ধা বারাক-কে পেয়েছিলেন, যার সহায়তায় তিনি যুদ্ধবাজ ও অত্যাচারী সেনাপতি সিসেরাকে পরাজিত করেছিলেন। দেবোরাহর প্রজ্ঞা ও ঈশ্বরের উপর তাঁর বিশ্বাস জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাঁর নেতৃত্বে ইস্রায়েল দেশে ৪০ বছর ধরে শান্তি বিরাজ করেছে।

১০। দেলিলাহ্: সামশনের ওপর মন্দ প্রভাব (বিচারক ১৬: ৪-২১)
দেলিলাহ্ তাঁর সৌন্দর্য্য ও যৌন আবেদন ব্যবহার করে পরম শক্তিশালী সামশনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন; সামশনের যৌন চাহিদা মিটাতে গিয়ে তিনি তাঁকে কাবু করেছিলেন। ইস্রায়েলের ওপর একজন বিচারক ছিলেন সামশন; তিনি ইস্রায়েলের একজন সেনানায়কও ছিলেন; যিনি বহু ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছিলেন। তাই ফিলিস্তিনীরা তাঁর ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ খুঁজছিল। তারা তাই দেলিলাহ্কে দিয়ে তাঁর শক্তির উৎস লম্বা চুল সম্পর্কে জানতে পারে। সামশন ঈশ্বরের কাছে ফিরে যান, কিন্তু তাঁর মৃত্যু ছিল মর্মান্তিক। সামশন ও দেলিলাহের ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে আত্মসংযম কত গুরুত্বপূর্ণ – নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে একদিন পতন হবে অচিরেই।

১১। রুথ: যিশুর স্বনামধন্য পূর্বপুরুষ (রুথ ১: ১৬-১৭)
রুথ ছিলেন একজন নামকরা যুবতী বিধবা। তাঁর চরিত্র এতই শক্তিশালী ছিল যে তাঁর প্রেমকাহিনী গোটা বাইবেলের মধ্যে অন্যতম একটি গল্প হয়ে আছে। দুর্ভিক্ষের পর মোয়াব দেশ থেকে তাঁর ইহুদি শাশুড়ী নাওমি যখন ইস্রায়েল দেশে ফিরে যান, তখন রুথ তাঁর সঙ্গে সেখানে যেতে ও তাঁর ঈশ্বরকে পূজা করার বায়না ধরে। তাঁর স্বজাতি উদ্ধারকর্তা বোয়াজ রুথকে বিয়ে করেন এবং উভয় নারীকে তাঁদের দারিদ্র্য থেকে রক্ষা করেন। মথি রচিত মঙ্গল সমাচার (১:৫) থেকে আমরা জানতে পারি যে রুথ ছিলেন রাজা দাউদের পূর্বপুরুষ আর রাজা দাউদের বংশেই যিশুর জন্ম হয়।

১২। হান্নাহ্: সামুয়েলের মা (সামুয়েল ১:২-২:২১)
হান্নাহ্ ছিলেন প্রার্থনায় বিশ্বস্ত। বহু বছর বন্ধ্যা থাকার পর তিনি তাঁর বিরামহীন প্রার্থনার ফলে ঈশ্বরের কাছ থেকে একটি সন্তান লাভের অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। তিনি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, যার নাম রাখেন সামুয়েল। আর তিনি নিজের কথা রেখে তাঁর এই সন্তানকে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করেছেন। সামুয়েল তাই হয়ে উঠেছিলেন ইস্রায়েল জাতির সর্বশেষ বিচারক, প্রবক্তা এবং রাজা সৌল ও দাউদের পরামর্শদাতা। হান্নাহ্-এর কাছ থেকে শিখতে পারি যে, যদি আমাদের সবচেয়ে বড় আকাঙ্খা হয় ঈশ্বরের গৌরব করা, তাহলে ঈশ্বর আমাদের সেই আকঙ্খা বা প্রার্থনা পূরণ করেন।

১৩। বাথসেবা: সলোমনের মা (২ সামুয়েল ১১-১২ এবং ১ রাজা ১-২)
বাথসেবা রাজা দাউদের সঙ্গে একপ্রকার ব্যভিচারের কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন; কিন্তু ঈশ্বরের সাহায্যে তিনি তা একটি ভাল কাজে পরিণত করেছিলেন। বাথসেবার স্বামী উরিয়াহ্ যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন, যখন দাউদ বাথসেবার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। আর দাউদ যখন জানতে পারলেন যে বাথসেবা গর্ভবতী হয়েছেন, তখন তিনি এমন ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থা নিলেন যেন উরিয়হ্ যুদ্ধে নিহত হন। প্রবক্তা নাথান দাউদের এই পাপ কাজে বাধা সৃষ্টি করেন এবং তাঁর পাপ স্বীকার করতে বাধ্য করেন। যদিও বাথসেবার সেই সন্তান মারা যায়, কিন্তু পরেরবার রাজা দাউদের ঔরষে বাথসেবা জগতবিখ্যাত প্রাজ্ঞব্যক্তি সলোমনকে জন্ম দেন। বাথসেবা আমাদের দেখান যে ঈশ্বরের কাছে  ফিরে আসলে পাপী ব্যক্তিরাও তাঁর অনুগ্রহ লাভ করতে পারে।

১৪। যেসাবেল: ইস্রায়েলের প্রতিশোধ পরায়ন রাণী
যেসাবেল তাঁর দুষ্কর্মের দ্বারা এমন কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন যে এখনও প্রতারক নারীদের বর্ণনা করতে তাঁর নাম ব্যবহার করা হয়। রাজা আহাবের স্ত্রী হিসাবে তিনি প্রবক্তা এলিজার মত প্রবক্তাদেরও নির্যাতন করেছেন। তাঁর পৌত্তলিক ধর্মের বাল দেবতার পূজা-অর্চনা ও নিষ্পাপ মানুষদের হত্যা পরিকল্পনার কারণে ঈশ্বর তাঁর পতন ঘটান। ঈশ্বর প্রেরিত একজন মানুষ, যার নাম ছিল যেহু, যখন পৌত্তলিক দেব-দেবীর মূর্তি ভাঙ্চুর করছিলেন, তখন একজন ইউনুখ তাঁকে বেলকনি থেকে নীচে ফেলে দেয় আর যেহুর ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে। কুকুরেরা তাঁর মাংস খেয়ে ফেলে, ঠিক যেমনটি প্রবক্তা এলিজা বলেছিলেন।

১৫। এস্থার: পারস্য দেশের প্রভাবশালী রাণী (এস্থার গ্রন্থ)
রাণী এস্থার ইহুদি জাতিকে রক্ষা করেছিলেন, আর এইভাবে তিনি ভাবষ্যৎ ত্রাণকর্তা যিশুর বংশকেও রক্ষা করেছিলেন। তিনি সুন্দরী প্রতিযোগিতায় জিতে পারস্য রাজ জেরজেস্ (সুসা)-এর রাণী হয়েছিলেন। তবে একজন দুষ্ট রাজকর্মকর্তা হামান সকল ইহুদিকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছিল। এস্থারের কাকা মোরদেকাই তাঁকে পরামর্শ দিলেন যেন রাজাকে গিয়ে তিনি সত্য কথাটি বলে দেন। শীঘ্রই টেবিল উল্টে যায়, রাজা হামানকে মৃত্যুদন্ড দেন এবং পরে হামানের স্থানে মোরদেকাইকে নিয়োগ দেন।

১৬। মারিয়া: যিশুর অনুগত জননী (মঙ্গল সমাচারসমূহ)
বাইবেলে মারিয়া হলেন এমন এক উদাহরণ যিনি ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়েছিলেন। প্রভুর এক দূত মারিয়াকে বলেছিলেন যে পবিত্র আত্মার প্রভাবে তিনি একজন পুত্র সন্তানের জন্ম দিবেন, যিনি হবেন জগতের পরিত্রাতা। সম্ভাব্য দুর্নাম ও সামাজিকভাবে অপমানিত হওয়ার ভয় কাটিয়ে তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সপেঁ দিয়ে যিশুকে জন্ম দিয়েছিলেন। যোসেফ ও মারিয়া বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ঈশ্বর-পুত্র যিশুর পিতামাতা হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। জীবিতকালে মারিয়া অনেক দুঃখ ও কষ্টভোগ করেছিলেন, এমন কি কালভারী পর্বতে তাঁর সন্তান যিশুর ক্রুশীয় মৃত্যু দেখে কষ্ট ও যন্ত্রনা পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যিশুকে পুনরুত্থিত হতেও দেখেছিলেন। যিশুর উপর মারিয়ার প্রভাব পড়েছিল এবং ঈশ্বরের প্রভুর একজন ভক্তিপ্রাণা দাসী, যিনি ঈশ্বরকে “হ্যাঁ” বলেছিলেন।

১৭। এলিজাবেথ: দীক্ষাগুরু যোহনের মা (লুক ১ ও ২ অধ্যায়)
বাইবেলে বন্ধ্যা নারীদের মধ্যে এলিজাবেথ বিশেষ স্থান দখল করে আছেন কারণ তাঁকে ঈশ্বর বেছে নিয়েছিলেন বিশেষ সম্মানের জন্য। তাঁর বৃদ্ধ বয়সে ঈশ্বর তাঁকে সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা দিয়েছিলেন, তিনি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন যিনি ছিলেন দীক্ষাগুরু যোহন, যিনি ছিলেন একজন প্রবক্তা এবং মুক্তিদাতা মশিহের আগমনবার্তা ঘোষণাকারী। হান্নাহ্-এর মত তিনিও ছিলেন দৃঢ় বিশ্বাসী মানুষ। তাঁর সেই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে তিনি ঈশ্বরের মুক্তি পরিকল্পনায় তিনি সহযোগি হয়েছিলেন। এলিজাবেথের জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি যে খারাপ পরিস্থিতিকেও ঈশ্বর উল্টে দিয়ে ভাল কিছু করতে পারেন।

১৮। মার্থা: লাজারের উদ্বিগ্ন বোন (লুক ১০: ৩৮-৪২; যোহন ১১: ১-৪৪, ১২: ২)
মার্থা ছিলেন লাজার ও মারিয়ার বোন। যিশু ও তাঁর শিষ্যগণ প্রায়ই তাঁদের বাড়ীতে আসতেন আর মার্থা তাঁদের আপ্যায়ন, খাবার-পানীয় পরিবেশন ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিতেন। একবার যখন যিশু তাঁদের বাড়ীতে আসেন, তাঁর বোন মারিয়া তাঁকে খাবার তৈরীতে সাহায্য না করে যিশুর কাছে বসে তাঁর কথা শুনছিলেন, তখন রেগে গিয়ে বোনের এই আচরণের বিষয় যিশুর কাছে অনুযোগ করেছিলেন; এই ঘটনার জন্য মার্থাকে বিশষভাবে স্মরণ করা হয়। তবে মার্থ যিশুর যে প্রেরণকাজ সেই বিষয় সম্যক জ্ঞান রাখতেন। লাজারের মৃত্যু হলে মার্থা যিশুকে বলেছিলেন, “হ্যাঁ প্রভু, আমি বিশ্বাস করি যে আপনি ঈশ্বরপুত্র সেই খ্রিস্ট, যাঁর এই জগতে আসার কথা আছে।”

১৯। বেথানির মারিয়া: যিশুর স্নেহময়ী অনুসারী (লুক ও যোহন রচিত মঙ্গলসমাচার)
বেথানির মারিয়া তাঁর বোন মার্থার সঙ্গে মিলে লাজারের বাড়ীতে যিশুকে ও তাঁর শিষ্যদের আতিথিয়েতা প্রদান করতেন ও যিশুর কথা শুনতেন। মার্থা কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, মোরিয়া ছিলেন ধ্যানী বা চিন্তা ভাবনা সম্পন্ন। একবার যখন যিশু তাঁদের বাড়ীতে আসেন তখন তিনি তাঁর বোন মার্থাকে সাহায্য না করে, বরং যিশুর কাছে বসে তাঁর কথা শুনছিলেন। যিশু বলেছিলেন যে মারিয়া ছিলেন প্রজ্ঞা-সম্পন্ন, কারণ তিনি যে সম্পদ নষ্ট হয় না, সেই সম্পদ আহরণের জন্য চেষ্টা করছেন। আদি মণ্ডলির যে সব ভক্তিপ্রাণা নারী যিশুর প্রচারকাজে সর্বস্ব দিয়ে সহায়তা করেছেন, তাঁদের মধ্যে মারিয়া ছিলেন অন্যতম। তাঁর আদর্শ জীবন আমাদের শিক্ষা দেয় যে খ্রিস্টমণ্ডলির প্রেরণকাজে খ্রিস্টবিশ্বাসীদের সমর্থন ও সহায়তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

২০। মারিয়া মাগ্দালেনা: যিশুর অটলবিশ্বাসী শিষ্য (মঙ্গলসমাচারসমূহ)
মারিয়া মাগ্দালেনা তাঁর মৃত্যু পর্যন্তু যিশুর উপর অটল বিশ্বাসী হয়ে থেকেছিলেন। যিশু তাঁর ভিতর থেকে সাতটি অপদূত তাড়িয়েছিলেন; সেইজন্য যিশুও তাঁকে স্থায়ীভাবে ভালবেসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে যিশুর সম্পর্ক নিয়ে অনেক রকম কল্প-কাহিনী বা মনগড়া গল্প ও কাহিনী প্রচলিত হয়ে আছে। বাইবেলে তাঁকে নিয়ে বলা হয়েছে, শুধু সেই কাহিনীই সত্য, কারণ প্রত্যক্ষ্য-দর্শী মঙ্গল সমাচার লেখকগণ তা লিখে গিয়েছেন। ক্রুশে যিশুর মৃত্যুর সময় যিশুর শিষ্যদের প্রায় সকলেই পালিয়ে গেলেও শুধু যিশুর মা মারিয়া ও প্রেরিত শিষ্য যোহনের সঙ্গে মারিয়া মাগ্দালেনা উপস্থিত ছিলেন। যিশু যে রবিবার পুণরুত্থান করেন সেইদিন খুব ভোরে মারিয়া মাগ্দালেনা যিশুর মৃতদেহে সুগন্ধি তেল মাখাতে তাঁর কবরে গিয়েছিলেন। যিশু মারিয়া মাগ্দালেনাকে এতই ভালবেসেছিলেন যে তাঁর কাছেই পুণরুত্থিত যিশু প্রথম দেখা দিয়েছেন।

মানব পরিত্রাতা যিশুখ্রিস্টের মুক্তির ইতিহাসে বাইবেলে বর্ণিত এই নারীগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। যদিওবা একেকজনের চরিত্র একেক ধরণের ছিলো তবু এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ইতিহাসে এটা প্রয়োজন ছিলো। বাইবেলের পুরাতন নিয়মে এই নারীদের উপস্থিতি বেশী সংখ্যায় লক্ষ্যণীয়। তবে নতুন নিয়মে হাতেগোনা কয়েকজনই সাক্ষ্যবহন করে। ফলে এটা স্পষ্ট যে বাইবেলের পুরাতন নিয়মের নারীগণ নতুন নিয়মের নারীদের মধ্য দিয়ে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। আর নতুন নিয়মের নারীগণ পুরাতন নিয়মের নারীদের প্রতিচ্ছবি। পরিশেষে এটা বলা যায় যে, বাইবেলের নতুন নিয়ম হচ্ছে পুরাতন নিয়মের পূর্ণতা।

Please follow and like us: