ফাদার সাগর কোড়াইয়া

আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ ফ্রান্সিসের জন্ম। জন্মের পর নাম রাখা হয় জর্জ মারিও বার্গোগলিও। ইতালীয় বংশোদ্ভূত এই ছেলেটি বড় হচ্ছিল এক অনাড়ম্বর পরিবারে। বাবা ছিলেন রেলওয়ের হিসাবরক্ষক, আর মা ঘর সামলাতেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে জর্জ ছিল একেবারে মাঝামাঝি। খেলাধুলায় খুব উৎসাহী ছিলো না। তবে বই পড়তো খুব।

জর্জ বড় হতে লাগল। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করে রসায়নে ডিপ্লোমা করলো। একটা ল্যাবরেটরিতেও কাজে যুক্ত ছিলো। কিন্তু তার মন ছিলো অন্য কোথাও। সেই ডাকটা এসেছিল একদিন অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। ২১ বছরের তরুণ জর্জ তখন ঠিক করল, সে সেমিনারীতে প্রবেশ করে যাজক হবে।

জর্জ সেমিনারীতে প্রবেশ করলো। ১৩ ডিসেম্বর ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি জেজুইট সম্প্রদায়ে যাজকীয় অভিষেক লাভ করেন। একজন যাজক, অধ্যাপক, অধ্যক্ষ হয়ে তিনি সাধারণ মানুষের কথা ভুলেননি। কারো ঘরে ভাত নেই, কারো শরীরে রোগ, কেউবা ঘুমায় রাস্তায়- এইসব মানুষের মাঝেই তিনি খুঁজে পেতে লাগলেন যিশুর মুখ।

১৯৯২ খ্র্রিস্টাব্দের ২৭ জুন ফাদার জর্জ মারিও বুয়েন্স আয়ার্সের আর্চবিশপ হন। এই শহরেই তিনি জন্মেছিলেন আবার এই শহরেরই আধ্যাত্মিক অভিভাবক হয়ে উঠেন। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি ফাদার জর্জ পোপ সাধু দ্বিতীয় জন পল কর্তৃক কার্ডিনাল মনোনীত হন। কিন্তু এখানেও তার জীবন ছিল সাধারণ। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন, নিজের রান্না নিজে করতেন। তার যাতায়াত ছিলো সাধারণ বাস-ট্রামে। ১৩ মার্চ ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ১১৫ জন কার্ডিনালের ভোটে পোপ নির্বাচিত হন। তিনি নিজের জন্য আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের নাম বেছে নিলেন। এভাবেই জর্জ থেকে হয়ে উঠলেন পোপ ফ্রান্সিস।

পোপ ফ্রান্সিস হলেন দরিদ্রদের পোপ। পোপ হওয়ার পরই তিনি বললেন, মণ্ডলী দরিদ্র, দরিদ্রদের জন্য। মণ্ডলী শুধু গির্জায় থাকবে না, রাস্তায় নামবে। যাজকদের গায়ের গন্ধ হোক রাখালের মতো। যেন শরীর থেকে মেষের গন্ধ বের হয়। পোপ ফ্রান্সিস নিজের ঝকঝকে প্রাসাদে নয়, থাকতেন সান্তা মার্থার একটি সাধারণ কক্ষে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন “আমি কে, কাউকে বিচার করার?” এ কাহিনী শুধুই একজন ধর্মীয় নেতার নয়, এ এক মানবিক বিপ্লবের গল্প। যে মানুষটা বোঝাত দয়া, নম্রতা আর সেবা শুধু ধর্ম নয়, এটাই জীবন।

পোপ ফ্রান্সিস জোর দিলেন দরিদ্রতা ও বৈষম্য দূর করার উপর। কাথলিক মণ্ডলীকে বললেন, গর্ভপাত, সমকামিতা, বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে কম কথা বলো। বরং কথা বলো দয়া, সহানুভূতি, আশ্রয় নিয়ে। এটাই ছিল একটা নীরব বিপ্লব। কেউ কেউ এতে অস্বস্তি বোধ করল, বিশ্বজুড়ে কানাঘুষাও হলো, কিন্তু বহু মানুষ প্রথমবারের মতো মণ্ডলীতে ফিরে এল। পোপ ফ্রান্সিস গাড়িও বদলে ফেললেন। জমকালো মার্সিডিজ বেঞ্জ নয়, একটা ফিয়াট ৫০০তে চড়ে বের হতেন। একবার এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি পোপ হয়ে কী পরিবর্তন এনেছেন? তিনি হেসে বলেছিলেন, জুতো। এখন লাল জুতো পরে থাকতে হয় না!

জানা যায় পোপ ফ্রান্সিস রাতের বেলা ভাটিকান চত্ত্বরে একাকী বেরিয়ে পড়তেন। ঘুরে দেখতেন রাতের ভাটিকান। তিনি তখন কেবলমাত্র পোপ হয়েছেন। খুব ভোরে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে দেখতে পান সুইসগার্ড ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। পোপ সুইসগার্ডকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সারারাত দাঁড়িয়ে ছিলো কিনা জিজ্ঞেস করলেন। পোপ নিজের ঘরে গিয়ে সুইসগার্ডের জন্য স্যাণ্ডউইচ এনে দিলেন। এই পোপ মানবিক পোপ না হয়ে থাকতে পারেন না।

২০১৫ খ্রিস্টাব্দে পোপ ফ্রান্সিস বিশ্ববাসীকে চমকে দিলেন তাঁর বিখ্যাত পরিবেশ বিষয়ক প্রৈরিতিক পত্র ‘লাউদাতো সি’ প্রকাশ করে। সেখানে তিনি বললেন “পৃথিবী আমাদের সবার মা, আমরা তাকে বিষ দিচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু বৈজ্ঞানিক বা রাজনৈতিক নয়, নৈতিক বিষয়।” ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে জলবায়ু বিষয়ক ‘লাউদাতো দেউম’ নামক আরেকটি পত্র লিখেন। তিনি বলেন, “মানব জাতি লোভের বশবর্তী হয়ে যখন ঈশ্বরের স্থান দখল করবে তখন তারা নিজেরা নিজেদের শক্রুতে পরিণত হবে।”

 

রোহিঙ্গা নিপীড়নের প্রসঙ্গে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে এসে বলেছিলেন, রোহিঙ্গারাও ঈশ্বরের সন্তান। তাদের নাম উচ্চারণে যদি ভয় হয়, তাহলে আমাদের বিশ্বাস দুর্বল। সেই সময় পোপ ফ্রান্সিসকে রিকশায় নিয়ে ঘুরার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। সত্যি বলতে পোপকে রিকশায় ‍উঠানোর পর তাঁকে আমার হালকা মনে হয়েছে। রিকশার হাতল মাত্র ধরে ছিলাম। মঞ্চের সামনে পোপকে নামিয়ে দিলাম। পোপ আমাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুললেন না। রিকশা নিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পোপ আমাকে ডাকালেন। কাছে গেলাম। উপহার হিসাবে রোজারিমালা দিলেন। এ রকম মানবিক গল্প আরো বহু রয়েছে।

পোপ ফ্রান্সিস শুধু ধর্মগুরু ছিলেন না, ছিলেন একজন রাজনৈতিক বিবেক। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘর্ষে উভয়পক্ষকে শান্তির বার্তা দিয়েছিলেন। ২০২০ খ্রিস্টাব্দে যখন পুরো পৃথিবী করোনার থাবায় ঘরে ঢুকে গেছে, তখন তিনি একা দাঁড়িয়েছিলেন ভ্যাটিকানের সেই খালি চত্বরে, বৃষ্টিতে ভিজে, প্রার্থনায় মগ্ন হয়ে। তার সেই একাকী ছবি বিশ্বব্যাপী হয়ে উঠেছিল আশার প্রতীক।

শেষের দিকে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ছিল। হাঁটা হয়ে উঠছিল কষ্টের, বাতের ব্যথা, ফুসফুসের জটিলতা। ফলে দীর্ঘ একমাস তাঁকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকতে হয়েছিলো। অনেকটা সুস্থ হয়ে ফিরেও এসেছিলেন। মৃত্যুর আগের দিনও পুনরুত্থান উৎসবে পোপ ফ্রান্সিস শান্তির কথা বলেছেন। তাঁর পক্ষে একজন বলেন, অন্যের মতামতের প্রতি সম্মান ছাড়া কখনোই প্রকৃত শান্তি আসতে পারে না। ধর্মীয় স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়। তিনি গাজাবাসীদের স্মরণ করে বলেন, চলমান সংঘাতের কারণে সৃষ্ট মানবিক বিপরর‌্যয় দুঃখজনক। এই সংঘাত মৃত্যু ও ধ্বংস ডেকে আনছে।

২১ এপ্রিল। সবেমাত্র পুনরুত্থান পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। সবাই তখনো আনন্দের মধ্যে। ভাটিকান সময় সকাল ৭:৩৫ মিনিটে ৮৮ বছর বয়সে পোপ ফ্রান্সিস তাঁর বাসভবন সান্তা মার্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বিশ্বব্যাপী এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই পোপের ভক্তঅনুরাগীরা কষ্ট পান। কাথলিক মণ্ডলীর নেতৃত্ব দেওয়া অন্যধারার একজন ন্যায্যতাপূর্ণ মানবিক ও দরিদ্র পোপের জীবনাবসান ঘটে। জীবনের সমাপ্তি হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাঁর ন্যায্যতাপূর্ণ মানবিক গল্পগুলো শোনা যাবে যুগ যুগ ধরে। সেগুলো মানবসভ্যতাকে পথ দেখাবে সুন্দর ও শান্তির পথে।

 

 

 

Please follow and like us: