বিশপ জের্ভাস রোজারিও
আমেরিকা মহাদেশের প্রথম পোপ হোরগে মারিও বের্গলিও’র জন্ম হয় আরজেন্টিনা দেশে। তিনি ৭৬ বছর বয়সে পোপ পদে আসীন হন। পোপ হওয়ার পূর্বে তিনি ১৫ বছর বুয়েনস্ আয়ার্সের বিশপ ও আর্চবিশপ পদে মণ্ডলীর সেবা করেছেন। তিনি তখন বলতেন, “আমার জনগণ দরিদ্র, আর আমি তাদেরই একজন”। আর্চবিশপের প্রাসাদ ছেড়ে তিনি একটি সাধারণ আপার্টমেন্টে থাকতেন এবং নিজের খাবার নিজেই রান্না করতেন। তিনি তাঁর পুরোহিতদের পরামর্শ দিতেন যেন তারা মানুষের প্রতি দয়া ও মমতা দেখান এবং অসহায়দের জন্য তাদের গৃহের দরজা সর্বদা খোলা রাখেন। তিনি তাদের আত্মকেন্দ্রিক আধ্যাত্মিকতা অনুশীলন করতে বলতেন।
ন্যায্যতা শিক্ষা দিতে পোপ ফ্রান্সিস খ্রিস্টভক্তদের ধর্মশিক্ষা নিতে বলতেন- ঈশ্বরের দশ আজ্ঞা ও অষ্টকল্যাণবাণী থেকে শিক্ষা নিতে বলতেন। তাঁর মতাদর্শ ছিল অতি সাধারণ: “যদি তুমি খ্রিস্টকে অনুসরণ কর, তখন তুমি সহজেই বুঝতে পারবে যে, কোন মানব ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুন্ন করলে তা বড় পাপ হয়”। বুয়েনস্ আয়ার্সের আর্চবিশপ হওয়ার আগে তাঁর জীবনী সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায়নি। কিন্তু ২০০১ খ্রিস্টাব্দে আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক মন্দার সময় তিনি তাঁর ব্যয় সংকোচন নীতির জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৩৬ খ্রিস্টব্দে বুয়েনস্ আয়ার্সে পোপ ফ্রান্সিসের জন্ম হয়। তাঁর পিতা-মাতা ছিলেন ইটালীয় অভিবাসী। তাঁর বাবা মারিও বেরগলিও রেলওয়ে বিভাগে একজন হিসাব রক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন আর মা রেজিনা সিভরি ছিলেন একজন বিশ^স্ত গৃহিনী, যিনি তাঁদের পাঁচ সন্তানকে মানুষ করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। হোরগে একজন কেমিক্যাল টেকনিশিয়ান হিসাবে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। তারপর তিনি যাজক হওয়ার জন্য ধর্মপ্রদেশীয় সেমিনারীতে যান। কিন্তু পরে তিনি ১১ মার্চ ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে যিশু সংঘের (জেজুইট সম্প্রদায়ের) নভিসিয়েটে প্রবেশ করেন। তিনি চিলি দেশে গিয়ে মানবিক বিভাগে পড়াশুনা করে পরে আর্জেন্টিনায় ফিরে সান মিগেল শহরে দর্শন শাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করেন। এরপর ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ তিনি বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সান হোসে কলেজে ঐশতত্ত¡ পড়াশুনা করেন।
পোপ ফ্রান্সিস ১৩ ডিসেম্বর ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে যাজকপদে অভিষিক্ত হন। তারপর ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্পেন দেশের আলকালা দে হেনারেস বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পড়াশোনা অব্যাহত রাখেন। তিনি যিশু সংঘে তাঁর শেষ ব্রত করেন ২২ এপ্রিল ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। আর্জেনটিনায় ফিরে তিনি সান মিগেলে ভিল্লা বরিলারিতে নবিস মাষ্টার নিযুক্ত হন; একই সঙ্গে তিনি সান মিগেলের ঐশতত্ব বিভাগে অধ্যাপনাও করেন; তিনি যিশু সংঘের প্রভিন্সিয়াল সুপেরিওরের একজন পরামর্শক; ও কলেজিও মাক্সিমোর পরিচালক হিসাবেও কাজ করেন।
পোপ ফ্রান্সিস ৩১ জুলাই ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে আর্জেন্টিনায় যিশু সংঘের প্রভিন্সিয়াল সুপেরিওর নিযুক্ত হন এবং ৬ বছর দায়িত্ব পালন করেন। তারপর তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশায় ফিরে যান। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার সান মিগেলে কলেজিও সান হোসে উচ্চ সেমিনারীর পরিচালক নিযুক্ত হন এবং একই সঙ্গে তিনি সেখানে সান হোসে ধর্মপল্লীর পাল পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রী সম্পন্ন করার জন্য জার্মানীতে যান; কিন্তু তাঁর সুপেরিওর তাঁকে বুয়েনস্ আয়ার্সের কর্ডোবায় সান সালভাদর কলেজে পাঠান একই সঙ্গে তিনি কর্ডোবায় স্থানীয় ধর্মপল্লীতে আধ্যাত্মিক পরিচালক ও পাপস্বীকার শ্রোতার কাজও করেন।
বুয়েনস্ আয়ার্সের কার্ডিনাল আর্চবিশপ আন্তনিও কোয়ারাচিনো ফ্রান্সিসকে যিশু সংঘের কাছ থেকে তাঁর একজন সাহায্যকারী হিসাবে চেয়ে নেন। আর প্রয়াত সাধু পোপ জন পল তাঁকে ২০ মে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে বুয়েনস্ আয়ার্সের একজন সহকারী বিশপ নিযুক্ত করেন। ২৭ মে তাঁর বিশপীয় অভিষেক সম্পন্ন হয় কার্ডিনাল আন্তনিওর হাতে। তারপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে সেখানকার ফ্লোরেস অঞ্চলের এপিসকোপাল ভিকার নিয়োগ করা হয় এবং ২১ ডিসেম্বর ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে বুয়েনস্ আয়ার্স আর্চডাইওসিসের ভিকার জেনারেল নিয়োগ করা হয়। পরে ৩ জুন ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে একই আর্চডাইওসিসের কো-আডজুটর আর্চবিশপ পদে উন্নীত করা হয়। কিন্তু মাত্র ৯ মাস পরে যখন কার্ডিনাল আন্তনিও কোয়ারাচিনো মৃত্যুবরণ করেন তখন ২৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে বুয়েনস্ আয়ার্সের আচবিশপ নিযুক্ত করা হয়। এইসঙ্গে তিনি আর্জেন্টিনার প্রাইমেট ও প্রাচ্য (অর্থডক্স রীতির) মণ্ডলীর খ্রিস্টবিশ্বাসীদের অভিভাবক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন।
২১ ফেব্রুয়ারী ২০০১ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত কনসিস্টরীতে পোপ ২য় জন পল ফ্রান্সিসকে কার্ডিনাল পদে উন্নীত করেন এবং তাঁকে সাধু রবার্ট বেলার্মিনের পদক দান করেন। তাঁর কার্ডিনাল হওয়ার অনুষ্ঠান করার জন্য তিনি তাঁর খ্রিস্টভক্তদের রোম নগরীতে আসতে নিষেধ করেন। বরং তাদের ভ্রমণ করার সেই টাকা দিয়ে গরীবদের সাহায্য করতে বলেন। আর্জেন্টিনা কাথলিক ইউনিভার্সিটির গ্র্যাণ্ড চ্যাঞ্চেলর হিসাবে তিনি ৩টি বইও প্রকাশ করেন। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে তাঁকে বিশপগণের সাধারণ ধর্মসভা বা সিনোড সভার বিশপগণের সেবাকাজ সম্পর্কে রিলেটর নিয়োগ করা হয়। বস্তুত: এই কাজটি করার কথা ছিল নিউইয়র্কের আর্চবিশপ এডুয়ার্ড মাইকেল এগানের, কিন্তু তিনি সেই বছর ১১ সেপ্টেম্বর ঘটনার কারণে সেখানে আসতে পারেননি। তাই এই দায়িত্বটি তাঁকে দেওয়া হয়েছিল একেবারে শেষ মুহুর্তে। তিনি সেই সিনোডে বিশপগণের প্রাবক্তিক ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ রেছিলেন; অর্থাৎ বিশপের দায়িত্ব হবে ন্যায্যতার প্রবক্তা; তাঁর প্রধান দায়িত্ব হল বিরামহীনভাবে বাণী ঘোষণা করা। বিশ্বাস ও নৈতিকতা শিক্ষা দিতে গিয়ে বিশপকে শিক্ষা দিতে হবে কাথলিক মণ্ডলীর সামাজিক শিক্ষার বিষয়ও ।
মণ্ডলীতে ভূমিকার জন্য কার্ডিনাল বের্গলিও গোটা লাটিন আমেরিকা জুড়ে একটি অতিপরিচিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। এতসব সত্ত্বেও কার্ডিনাল বের্গলিও তাঁর কঠোর কৃচ্ছ্বতার জীবন ত্যাগ করেননি। এই কারণে তিনি ২০০২ খ্রিস্টাব্দে আর্জেন্টিনার কাথলিক বিশপ কনফারেন্সের সভাপতি হতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু তিন বছর পর তাঁকে সেই কনফারেন্সের সভাপতি নির্বাচন করেন যা ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে নবায়ন করা হয়। ইতিমধ্যে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি রোমে অনুষ্ঠিত কার্ডিনালগণের “কনক্লেভ” সভায় যোগদান করেন, যেখানে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট কাথলিক মণ্ডলীর প্রধান নির্বাচিত হন।
ত্রিশ লক্ষ খ্রিস্টভক্তের বিশাল আর্চডাইওসিস বুয়েনস্ আর্য়াসের আর্চবিশপ হিসাবে তিনি একটি একটি প্রকল্প নিয়েছিলেন যার ভিত্তি ছিল ‘মিলন ও বাণীপ্রচার’। তাঁর চারটি লক্ষ্য ছিল: উদার ভ্রাতৃসমাজ; আলোকিত ভক্তমণ্ডলীর নেতৃত্ব, শহরের সকল বাসিন্দাকে লক্ষ্য রেখে বাণীপ্রচার এবং দরিদ্র ও অসুস্থ্যদের সাহায্য করা। তিনি বুয়েনস্ আয়ার্সে নতুন করে বাণী প্রচার শুরু করেছিলেন যার লক্ষ্য ছিল এর জনগণ, কাঠামো ও ইতিহাস। তিনি তাঁর পুরোহিত ও খ্রিস্টভক্তদের একত্রে কাজ করতে বলতেন। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে আর্জেন্টিনার স্বাধীনতা লাভের দুইশত বছর পূর্তিতে তিনি সকলের মধ্যে একটি সংহতি প্রচারণা শুরু করেন- যার লক্ষ্য ছিল ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দুইশত সংস্থা স্থাপন করা, যেসব সংস্থা দয়ার কাজ করবে। তিনি দক্ষিন আমেরিকা জুড়ে সকল স্থানীয় মণ্ডলীসমূহের নবজাগরণ আশা করেছিলেন।
কার্ডিনাল বের্গলিও রোমের বেশ কিছু দপ্তরের সদস্য ছিলেন: তিনি উপাসনা ও সাক্রামেন্ত সংক্রান্ত দপ্তরের একজন সদস্য ছিলেন। সেই সঙ্গে যাজকদের জীবন ও কাজ সম্পর্কিত দপ্তর, নিবেদিত ও প্রৈরিতিক জীবন বিষয়ক দপ্তর, পরিবার বিষয়ক দপ্তর ও লাটিন আমেরিকা বিষয়ক কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। এইসব দপ্তরে সভা সেমিনারের জন্য তিনি রোমে আসা যাওয়া করতেন এবং থাকতেন অতিসাধারণভাবে। তাঁর নিজের ব্যাগ তিনি নিজেই বহন করতেন, যা তিনি পোপ হওয়ার পরেও অব্যাহত রেখেছেন।
পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে রীতি ভেঙ্গে হঠাৎ করেই পদত্যাগ করেন, যা কাথলিক মণ্ডলীর কেউই কল্পনা বা আশা করেনি। পোপ বেনেডিক্টের ডাকা কার্ডিনালগণের কনসিস্টরী সভায় যোগ দিতে তিনি রোমে আসেন আর সেখানেই এই অভাবনীয় ঘটনাটি ঘটে, যার কারণে সেই কনসিস্টরী রূপ নেয় কনক্লেভ সভায়। সেই কনক্লেভের নির্বাচনে কার্ডিনালগণ তাঁদের স্বতীর্থ কার্ডিনাল বের্গলিওকে ভোট দিয়ে পোপ নির্বাচন করেন। মণ্ডলীর ঐতিহ্য অনুসরণ করে নতুন পোপ নাম ধারণ করেন ফ্রান্সিস; তিনি যিশু সংঘের সদস্য হলেও তিনি কোন যিশু সংঘী সাধুর নাম না নিয়ে, আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের নাম ধারণ কনে। এটা ছিল একটি চমক, কিন্তু তাঁর জীবননীতি সাধু ফ্রান্সিসের মতই ছিল। কার্ডিনাল বের্গলিও সেই যে কনসিস্টরী সভায় যোগ দিতে রোমে আসেন, আর আর্জেন্টিনায় তাঁর ধর্মপ্রদেশ বুয়েনস্ আয়ার্সে ফিরে যাওয়া হয়নি।
পোপ হওয়ার পরে তিনি তাঁর প্রথম পালকীয় সফর করেন দক্ষিন ইটালীর লাম্পেদুসা নামক ছোট দ্বীপে, যেখানে অনেক অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষ নৌকাডুবিতে মারা যায়। তাঁর হৃদয় ছিল অসহায় অভিবাসী ও শরনার্থীদের প্রতি দয়াদ্র ও সহমর্মী। তিনি বিশ্বের সর্বত্র ন্যায্যতা ও শান্তির সমাজ গড়ার আহ্বান জানান। তিনি বিশ্বে অন্তর্ভুক্তি ও সংহতির এক ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ গড়ার অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এমন কি তিনি যারা সমকামী তাঁদের প্রতিও সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে পোপ ফ্রান্সিস সকলকে সাবধান করে পরিনামদর্শী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ধরিত্রীকে উল্লেখ করেছেন আমাদের বসতবাটি বলে- আর এর যত্ন করার দায়িত্বও আমাদের সকলের। একটি পরিচ্ছন্ন ও সবুজ পৃথিবী গড়ার জন্য তিনি আমাদের পথ দেখিয়েছেন। তিনি বিশ্বভ্রাতৃত্বের আহ্বান জানিয়েছেন। পৃথিবীর সকল ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সত্যিকার অর্থেই ছিলেন মানব জাতির “বিবেক”। কারণ তিনি সব সময় সত্য ও ন্যায্যতার কথা বলতেন, বলতেন শান্তির কথা।
পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন এই যুগের একজন শক্তিশালী প্রবক্তা। যেখানে অন্যায্যতা ও শোষণ দেখেছেন সেখানেই তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠে সেসবের নিন্দা করেছেন। তিনি যুদ্ধ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে উচ্চকন্ঠ ছিলেন। সব সময় তিনি চাইতেন যেন আলাপ আলোচনা ও সংলাপের মধ্য দিয়ে সকল বিরোধ ও সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা হয়। তাঁর মৃত্যুর আগের দিন ইস্টার সানডে দুপরে প্রার্থনার পূর্বে তিনি গাজায় যুদ্ধ বন্ধের জোরালো আবেদন রেখেছেন। তিনি অসংখ্যবার আবেদন রেখেছেন ইউক্রেন ও রাশিয়ার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় তিনি রোহিঙ্গা শরনার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন, সমব্যাথী হয়েছেন।
পোপ ফ্রান্সিস শিক্ষা দিয়েছেন অন্যের মতামত আর কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে সম্মান না করলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, বৈষম্য ও হানাহানি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তিনি মানব সভ্যতার জন্য দু’টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অবিস্মরণীয় দলিল রেখে গেছেন একটি ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত “লাউদাতো সি” বা “তোমার প্রশংসা হোক” এবং অপরটি ২০২০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত “ফ্রাতেল্লী তুত্তি” বা “আমরা সকলে ভাইবোন”। প্রথমটির লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর বা ধরিত্রীর প্রতি ভালবাসা ও যত্ন নেওয়া এবং দ্বিতীয়টির লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা। মানব সভ্যতাকে টেকসই ও নিরাপদ করার জন্য পোপ ফ্রান্সিসের এই শিক্ষাকে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই।
পোপ ফ্রান্সিস কাথলিক মণ্ডলীর জন্য একটি মূল্যবান উপহার রেখে গেছেন আর তা হলো “সিনোডাল মণ্ডলী” এর ধারণা। বিগত ২০২৩ ও ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে রোমে অনুষ্ঠিত হয়েছে “সিনোডালিটির উপর সিনোড”। এতে অংশগ্রহণ করেছেন পোপ ফ্রান্সিস, কার্ডিনালগণ, বিশপগণের সঙ্গে যাজক, সন্ন্যাসব্রতী ও খ্রিস্টভক্তগণ। খ্রিস্টমণ্ডলী যেন সত্যিকার অর্থেই জনগণের মণ্ডলী হতে পারে সেই লক্ষ্যেই ছিল এই প্রয়াস। মণ্ডলীকে টিকে থাকতে হলে এই পদ্ধতিই একমাত্র পথ।
পোপ ফ্রান্সিস শুধু কথাই বলেননি, তাঁর পবিত্র ও নম্র জীবনাদর্শ দ্বারা দেখিয়েছেন যে তিনি একজন নিখাঁদ ভালো মানুষ ও একজন সাধু ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যে একজন ভালবাসার মানুষ ছিলেন তা তাঁর কথা ও আচরণ থেকেই বুঝা যেত। তা সত্ত্বেও অনেকেই তাঁর শিক্ষা ও সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। শুধু মণ্ডলীর বাইরে থেকে নয়, মণ্ডলীর ভিতর থেকেও অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ তাঁর অনেক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু তিনি তা ধৈর্য্য ও দৃঢ় মনোবল অথচ নম্রভাবে মোকাবেলা করেছেন। অনেকে তাঁর বিরূদ্ধে অযথা কুৎসা রটনা করেছে, কিন্তু তিনি তাদের জন্য প্রার্থনা করেছেন। তিনি কাথলিক মণ্ডলীর বিশপ ও যাজকদের পরামর্শ দিয়েছেন নম্র হতে আর “মেষদের গন্ধ শুকে নিতে” যেন তাদের সঙ্গে তাঁরা একাত্ম হতে পারেন এবং একটি শক্তিশালী, মিলনধর্মী ও টেকসই মণ্ডলী গড়ে উঠে। যিশুর পুনরুত্থান পর্ব পালনের ঠিক পরের দিন ২১ এপ্রিল ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে একমাস যাবৎ অসুস্থ্য থাকার পরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।