ফাদার সাগর কোড়াইয়া
প্রবন্ধের নামকরণে মন্সিনিয়র মার্শেল তপ্নর সমগ্র জীবনটা প্রকাশ পায়। সত্যিকার অর্থেই মন্সিনিয়র একজন সাদামনের মানুষ। সহজ-সরল জীবন যাপন কাকে বলে তা মন্সিনিয়রকে দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারবে। মন্সিনিয়র মার্শেলের শূন্য চাহিদা ও পাওয়া না পাওয়ার নিরাক্ষেপ যে কারো জন্য অনুসরণীয় হতে পারে। মন্সিনিয়রের যাজকীয় জীবনের পঁয়তাল্লিশ বছর অতিবাহিত হয়েছে; আর এই দীর্ঘ সময়টাতে তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাসহীন, নির্লোভ, নিরহঙ্কারী, মৃদুভাষী, বিশ্বস্ত এবং একজন প্রার্থনাশীল ব্যক্তিত্ব। শত ব্যস্ততাও মন্সিনিয়রকে কখনো প্রার্থনা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। আমার জ্ঞান হবার পর থেকে বোর্ণী ধর্মপল্লীতে মন্সিনিয়র মার্শেলকে পাল পুরোহিত হিসাবে পেয়েছি। ফলে মন্সিনিয়রকে নিয়ে স্মৃতিও রয়েছে বিস্তর।

ছোটবেলায় মন্সিনিয়রকে একজন গারো আদিবাসী ফাদার বলে মনে করতাম। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে ধারণা ভাঙ্গে। এই ভুল শুধু আমার একাই হয়নি; আরো অনেকেই এই ধারণা করতো বলে শুনেছি। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে মন্সিনিয়র মার্শেলকে মণ্ডলীর সন্মানসূচক মন্সিনিয়র উপাধি প্রদানকালে মন্সিনিয়রের পোশাক দেখে অনেকেই উনাকে কোরিয়ান বিশপ বলে মনে করেছে। মন্সিনিয়র মার্শেলের আরেক নাম ফিলিপ; তবে তিনি মার্শেল নামেই অধিক পরিচিত। মন্সিনিয়র মার্শেল তপ্নের পদবী নিয়ে দ্বিধায় পড়েছি অনেকবার। তপ্ন আর টপ্যের ঝামেলা অনেককেই পোহাতে হয়েছে। বেণীদুয়ার ধর্মপল্লীর মিশনপাড়ার একটি মুণ্ডারী আদিবাসী পরিবারে তিনি ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
মন্সিনিয়র মার্শেল ছোটবেলা থেকে বেণীদুয়ার ধর্মপল্লীর সন্তান শহীদ ফাদার লুকাশ মারাণ্ডী, অগ্রজ ফাদার মার্কুস মারাণ্ডী এবং তপ্ন পদবীধারী আরেকজন মুণ্ডারী আদিবাসী ফাদারকে দেখেছেন। আর তাদের দেখেই তিনি যাজক হবার মানসে সেমিনারীতে প্রবেশ করেন। দিনাজপুরের সেন্ট ফিলিপ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর নটর ডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং কলকাতার মর্নিং স্টার সেমিনারীতে বিএ পড়াশুনা করেন। এরপর বনানী মেজর সেমিনারে দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব সমাপ্ত করে যাজকীয় অভিষেক লাভ করেন ১ জানুয়ারি ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে।
বর্তমান রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপল্লীগুলো তৎকালীন দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের অধীনে ছিলো। যাজকীয় অভিষেকের পর মন্সিনিয়র মার্শেল তপ্ন বনপাড়া ধর্মপল্লীতে সহকারী পাল পুরোহিত ছিলেন। এরপর দিনাজপুরে সুইহারী ইন্টারমিডিয়েট সেমিনারীর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময়কার সেমিনারীয়ানদের ভাষ্যমতে, মন্সিনিয়র মার্শেল তপ্ন পরিচালক হিসাবে ছিলেন একজন পিতা ও বন্ধুর মতো। তিনি কখনো রাগতস্বরে কথা বলতেন না। সেমিনারীয়ানদের জন্য ছিলেন একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব। মন্সিনিয়রের কাছে খোলামনে সব কথা বলা যেতো।
পরবর্তীতে মন্সিনিয়র মার্শেল তপ্ন উচ্চ শিক্ষার জন্য ইটালীতে যান। পড়াশুনা সমাপ্ত করে ধানজুড়ি, ঠাকুরগাঁও, নতুন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের উপশহরে অবস্থিত বিশপ হাউজে দায়িত্বরত ছিলেন। এরপর তিনি বোর্ণী ধর্মপল্লীর পাল পুরোহিত হিসাবে দায়িত্ব পান। সে সময় বোর্ণী ধর্মপল্লী একটি ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। খ্রিস্টভক্ত এবং ধর্মপল্লীর মধ্যে একটি অদৃশ্য দূরত্ব ছিলো দৃশ্যমান। আর মন্সিনিয়র মার্শেল তপ্ন তখন যেন হয়ে উঠেছিলেন একজন জন মেরী ভিয়ান্নী। তিনি তার প্রাজ্ঞতা, ধার্মিকতা ও মৃদুশীলতা দ্বারা খ্রিস্টভক্তদের মন জয় করতে পেরেছিলেন।
আমি তখন সবেমাত্র প্রাইমারী স্কুলে পড়ি। বোর্ণীতে প্রতিমাসে একবার শিশুদের নিয়ে বিকালে মিটিং হতো। প্রায় তিনশ শিশু একসাথে জড়ো হতাম। প্রথমে কিছু কাজ; তারপর ফাদার, সিস্টার ও এনিমেটররা আমাদের শিক্ষা দিতেন। আর সেই সময় ফাদার মার্শেল তপ্ন প্রত্যেকটি মিটিংএ উপস্থিত থাকতেন। তিনি বরাবরই শিশুদের স্নেহ করতেন। বার্ষিক পরীক্ষা তখন শেষ হয়েছে। এমনই এক মিটিংএ ফাদার মার্শেল শিশুদের জিজ্ঞাসা করলেন, কারা বা কে পরীক্ষায় ফেল করবে হাত তুলো। যদি কেউ সত্য কথা বলে তাহলে তিনি মিষ্টি খাওয়াবেন বলেও প্রতিজ্ঞা করেন। কেউ আর হাত তুলে না। আমি সাহস করে হাত তুললাম। সে বছর ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা আমার খারাপ হয়েছিলো। ভেবেছিলাম ফেল করবো। ফাদার মার্শেল তপ্ন আমাকে দাঁড়াতে বললেন। দাঁড়িয়ে দেখি আমি একাই। ফাদার আমার সততার প্রশংসা করে ফাদার বাড়ি থেকে মিষ্টি এনে খাওয়ালেন। আর বললেন, যদি আমি পাশ করি তাহলে যেন ফাদারকে মিষ্টি খাওয়াই। পরে ঠিকই ফাদারকে মিষ্টি খাইয়েছিলাম।
এই ধরণের আরো নানা স্মৃতি রয়েছে ফাদারের সঙ্গে। ফাদার মার্শেল তখন বয়সে বেশ যুবক। সে সময় প্রতি বছর বোর্ণীতে ইটালী থেকে বিদেশীরা আসতো। গির্জার সামনের মাঠটা ছিলো তখন বেশ বড়। বিকাল হলেই বোর্ডিংএর ছেলেদের সাথে বিদেশীরা ফুটবল খেলায় মেতে উঠতো। আর তখন ফাদার মার্শেল তপ্নও ফুটবল মাঠে নেমে পড়তেন। ফুটবল খেলায় ফাদার বেশ দক্ষ ছিলেন। খেলার মধ্যে বিভিন্ন রকম জুকারী অঙ্গভঙ্গ করে আনন্দ দিতে পারতেন। মাঠের বাইরে বসে থেকে আমরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতাম।
আর একটি ঘটনা খুব মনে পড়ে। আমরা তখন আর একটু বড় হয়েছি। সেবক দলের বিশ্বস্ত সদস্য। প্রতি শুক্র ও রবিবার মিশনের প্রাঙ্গণে কাজ করতাম। মাঝে মাঝেই ফাদার মার্শেল ফাদার বাড়িতে আমাদের ডেকে নিয়ে ভিসিআর চালু করে দিতেন। সেই সময়ই চার্লি চ্যাপলিনের সাথে আমাদের প্রথম পরিচয়। ভিসিআর দেখতে দেখতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে যেতো বুঝতে পারতাম না। ফাদার মার্শেল বুঝতে পারতেন আমরা ক্ষুধার্ত। তিনি খাবার ঘর থেকে টিফিন এনে আমাদের খাওয়াতেন। তিনি প্রায়ই মোটর সাইকেল নিয়ে গ্রামে চলে যেতেন। সে সময় এলাকায় সাইকেল সচারচর তেমনটা চোখে পড়তো না। ফাদার মার্শেলের মোটর সাইকেলের আওয়াজ আমরা দূর থেকেই শুনতে পেতাম। ফাদারও গ্রামে গিয়ে শিশুদের বাইকে উঠিয়ে ঘুরে বেড়াতেন।
ফাদার মার্শেল তপ্ন বোর্ণীতে অত্যন্ত সফলতার সাথে দীর্ঘ সময় পাল পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি একে একে সুরশুনিপাড়া, আন্ধারকোঠা, বিশপ হাউজ ও কাথিড্রাল ধর্মপল্লীতে পাল পুরোহিত হিসাবে ছিলেন। প্রত্যেকটি ধর্মপল্লীতে তিনি বিশপের বাধ্য থেকে বিশ্বস্ততার সাথে সেবাদায়িত্ব পালন করেছেন। ফাদার প্রত্যেকটি ধর্মপল্লীতে অবস্থানকালে ধর্মপল্লীর আর্থিক স্বচ্ছলতার বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন। আর সে কারণে প্রতিটি ধর্মপল্লীর আর্থিক খাত বৃদ্ধির মনোভাব ফাদার মার্শেলের মধ্যে লক্ষ্যণীয় ছিলো। খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করার অনুরোধ জানালে মন্সিনিয়র মার্শেল তপ্ন কখনো কাউকে না করতেন না। তিনি প্রায়ই আক্ষেপ করে বলতেন, কত মানুষ খ্রিস্টযাগ পাবার আশা করে, আমাদের সময় থাকা সত্ত্বেও খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করি না। এটা তো অন্যদের প্রতি অন্যায্যতা।
ফাদার মার্শেল তপ্নের মধ্যে লেখকসত্তা ছিলো। সুরশুনিপাড়া ধর্মপল্লীতে থাকাকালীন সুরশুনিপাড়া ধর্মপল্লীর বিশটি গ্রাম নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও বেণীদুয়ার ধর্মপল্লী ও আদিবাসীদের নিয়ে আরো দুটি বই প্রকাশ করেন। এছাড়াও ফাদার পড়াশুনা করতেন খুব। আমার প্রকাশিত প্রত্যেকটি বইয়ের খুঁটিনাটি তিনি পড়েছেন। মাঝে মাঝে যখন সেগুলো নিয়ে গল্প করতেন তখন তা বুঝা যেতো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ফাদার মার্শেলের কর্মক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি কমে যেতে থাকে। তবে ফাদারের মধ্যে কর্মস্পৃহা ছিলো প্রচণ্ড পরিমাণ। নিজের কাজ অন্যের সহায়তা ছাড়া নিজেই করতে চাইতেন। অন্যের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকার মনোভাব ফাদার মার্শেলের মধ্যে নেই বললেই চলে। অসুস্থ থাকলেও অন্যকে কখনো জানতে দেন না। এমনকি বছরে দু’একবার একাকি বেণীদুয়ারে নিজের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন।
মন্সিনিয়র মার্শেল তপ্ন রহনপুর, লুইসপাড়া ও কাথিড্রাল ধর্মপল্লীতে সহাকারী পাল পুরোহিত ও মুশরইল সেমিনারীতে আধ্যাত্মিক পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। মন্সিনিয়রের ডায়াবেটিস রোগ তাকে দূর্বল করে ফেলে। তবু প্রায়ই তিনি হাঁটতে বের হন। বিশপ হাউজ থেকে মাঝে মাঝেই পাস্টোরাল সেন্টারে চলে আসেন। পুকুরপাড়ে নয়তো অন্য কোথাও একাকি বসে থাকতেন। আমি বরাবরই মন্সিনিয়র বলে সন্মোধন করি। আর এতে তিনি খুব খুশি হন। দেখা হলেই বলি, মন্সিনিয়র চলেন কফি খাই। আর মন্সিনিয়র বাধ্য শিশুর মতো কফি খেতে খাবার ঘরে প্রবেশ করতেন।
মন্সিনিয়র মার্শেলকে মন্সিনিয়র উপাধি দেওয়ার বছর আমি কাথিড্রালে রিজেন্সি করি। খ্রিস্টযাগের পর তিনি যে অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন তা আমার এখনো মনে পড়ে। উনার বলার কথাগুলো ছিলো অনেকটা এই রকম, মন্সিনিয়র উপাধি পাবার যোগ্য আমি নই। তবে মণ্ডলী আমাকে সন্মান জানিয়ে ও ভালবেসে এই উপাধি দিয়েছেন। আমার অন্তর আজ আনন্দে ভরপুর। আমি মণ্ডলীর প্রতি কৃতজ্ঞ। মন্সিনিয়র মার্শেল তপ্ন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের সবচেয়ে বয়োজেষ্ঠ্য পুরোহিত। নিখাদ সাদামনের মানুষ হিসাবেই যাজকীয় জীবনটা কাঁটিয়েছেন। চাওয়ার-পাওয়ার বহু ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন তিনি। নিঃস্বতার মধ্যে যে আনন্দ তা উপলব্ধি করেছেন জীবনাচরণে। নীরবতায় বহু উত্তর যে অনায়াসে দেওয়া যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ মন্সিনিয়র মার্শেল তপ্ন। উনার নিকট থেকে শেখার অনেক কিছু রয়েছে।