ফাদার সাগর কোড়াইয়া
বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলী পরিবেশ ও জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় দেশব্যাপী সমন্বিত আন্দোলন ও প্রেরণা যোগাতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এই চলমান জলবায়ু সংকট বিষয়ে কাথলিক বিশপ সম্মিলনী বেশ সোচ্চার। জাতীয় ন্যায় ও শান্তি কমিশনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের ৮টি ধর্মপ্রদেশে বাস্তবতা ও ভৌগলিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে জলবায়ু, শিশু সুরক্ষা, অভিবাসন, কারারক্ষী এবং মানবাধিকার সংরক্ষণে একযোগে উদ্যোগ গ্রহণ ও কাজ করে যাচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে যিশু খ্রিস্টের জন্ম জুবিলী বর্ষটি আরো বেশি গুরুত্ববহন করে। জুবিলীর মূলভাব “আমরা আশার তীর্থযাত্রী” মানুষের চেতনায় পরিবেশ ও জলবায়ুর এই চরম সঙ্কটের মূহুর্তে সাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। পরিবেশ ও জলবায়ু সংকটের এই ক্রান্তিলগ্নে প্রাণাঞ্চল ও ভৌগলিক বসতবাটি বসবাসযোগ্য হয়ে ওঠার আশায় অপেক্ষমান।
পুণ্যপিতা ফ্রান্সিস বিগত কয়েক বছর যাবৎ বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বেশ চিন্তিত। ইতিমধ্যে তিনি বিশ্বের কাছে জলাবায়ু বিষয়ক দুটি প্রৈরিতিক পত্র ‘লাউদাতো সি’ এবং ‘লাউদাতো দেউম’ লিখেছেন। এছাড়াও আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের প্রকৃতি প্রেমের সাথে একাত্ম হয়ে পুণ্যপিতা ফ্রান্সিস তার ধ্যান-অনুধ্যান ও আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সৃষ্টি পৃথিবীকে রক্ষায় সবাইকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলীও পোপের এই উদ্বাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্বমণ্ডলীর সাথে প্রতি বছর বিভিন্ন ধর্মপল্লী, প্রতিষ্ঠান, সংঘ-সমিতিতে ‘লাউদাতো সি’ সপ্তাহ উদযাপন করে থাকে।
এছাড়াও প্রতি বছর ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত ‘সৃষ্টি উদযাপনকা’ পালন করা হয়। আর এই আন্দোলন বিষয়ে যাজকগণ জনগণকে খ্রিস্টযাগে অবহিতকরণ ও লিফলেট বিতরণের মধ্য দিয়ে আরো বেগবান করছেন। ইতিমধ্যে অসংখ্যবার বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর জাতীয় ন্যায় ও শান্তি কমিশন থেকে সচেতনতামূলক লিফলেট প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়াও ‘সৃষ্টি উদযাপনকা‘ উপলক্ষে বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলীর জাতীয় প্রকাশনা সাপ্তাহিক প্রতিবেশীতে একটি বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশিত হয়।
বছরের দুটি সময়ে বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনী খ্রিস্টানদেরকে প্রকৃতি ও জলবায়ুর প্রতি সচেতন হতে, যতœ করতে এবং সংকট মোকাবেলায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করে। বিশপ সম্মিলনীর ন্যায় ও শান্তি কমিশনের সভাপতি বিশপ জের্ভাস রোজারিও জলবায়ু সংকট মোকাবেলার কথা বলেছেন। তিনি বিভিন্ন বক্তৃত্বা ও লেখনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে পরিবেশ ও জলবায়ু সংকটের কারণ ও মোকাবেলায় করণীয় দিক বিষয়ে বেশ সোচ্চার। তিনি বলেন, ভয়ঙ্কর এই পরিণতি ঠেকানোর আর কোন উপায় নেই এবং চলতি শতকের শেষে গিয়ে বিশ্বের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। তাহলে এর প্রভাব বিশ্বের একেক জায়গায় একেক রকম হবে। ইতিমধ্যে আমরা পৃথিবীর দিকে তাকালে সে চিত্রগুলো দেখতে পাচ্ছি। খ্রিস্টভক্ত হিসাবে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে রক্ষায় কাজ করে যাবার জন্য বিশপ জের্ভাস রোজারিও সবাইকে উৎসাহিত করেন।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনগুলোর মধ্যে হচ্ছে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা, অনাবৃষ্টি, খরা ও অতিবৃষ্টি। এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও অনেক বেশি। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় শীর্ষে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে নানা রকম প্রাকৃতিক সম্পদ ক্রমান্বয়ে হৃাস পাচ্ছে। নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। মানুষের অপরিণামদর্শী আচরণের ফলে আমাদের বসতবাটি এই পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুর যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে তা নিরাময়ে কাজ করা দরকার।
বাংলাদেশ বিশপ সম্মিলনীর ন্যায় ও শান্তি কমিশন প্রত্যেক বছর ‘চেতনায়ন’ নামক পত্রিকা প্রকাশ করে থাকে। আর এতে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রতি মানুষের চেতনা নিবদ্ধ করার জন্য লেখনীর আশ্রয় নেওয়া হয়। পোপ ফ্রান্সিসের ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত প্রৈরিতিক পত্র ‘লাউদাতো দেউম’ বা ‘ঈশ্বরের প্রশংসা’ (Laudato Deum) নামক প্রেরণাপত্রটি ইতিমধ্যে বাংলায় অনুবাদ করে বইয়াকারে প্রকাশ করা হয়েছে। পোপ ফ্রান্সিস এই প্রৈরিতিক পত্রের মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তরে প্রকৃতি ও জলবায়ুর প্রতি দয়াদ্র হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিগত কয়েক বছর যাবৎ সেই আলোকে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মপ্রদেশে কাজ অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও মণ্ডলীর বিভিন্ন সংঘ-সমিতি, সংস্থা, দল, গ্রাম, সমাজ ও ধর্মপল্লী ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে পরিবেশ ও জলবায়ুর সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে খ্রিস্টানদের সংখ্যা সীমিত। তবে দেশের সার্বিক কাজে অবদান ব্যাপক। চার বছর পূর্বে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া বৃক্ষরোপণ অভিযানের সাথে একাত্ম হয়ে বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায় দেশের বিভিন্ন স্থানে চার লক্ষাধিক গাছ রোপণ করেছে। আর এই উদ্যোগটি প্রশংসার দাবি রাখে। এছাড়াও ধর্মপ্রদেশগুলোর সংঘ-সমিতি, প্রতিষ্ঠান, ক্রেডিট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ধর্ম ও শ্রেণীভেদাভেদে জলবায়ু সংকট বিষয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনার, আলোচনা, সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান ও বৃক্ষরোপণ অভিযান অব্যাহত আছে। আর এ কর্মসূচী আয়োজনের কারণে জনগণ আগের চেয়ে এখন পরিবেশ বিপর্যয়, জলবায়ু সংকট বিষয়ে সচেতন এবং মোকাবেলা ও রক্ষায় কাজ করছে।
আশা আমাদের কখনো নিরাশ করে না। আশা ভবিষ্যতের পথ দেখায়। বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলীও সেই একই আশায় জুবিলী বর্ষ উদযাপন করছে। যিশু প্রকৃতিকে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। আর প্রকৃতির প্রতি যিশুর মানবিকতার চিত্র আমরা মঙ্গলসমাচারে দেখতে পাই। পৃথিবীর সৃষ্টিগুলোর প্রতি যিশুর ভালবাসাপূর্ণ এই প্রশংসা আমরা না করে কিভাবে থাকতে পারি! বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলীও বিশপ সম্মিলনীর নির্দেশানুযায়ী একই পথে ‘আশার তীর্থযাত্রী’। পোপ ফ্রান্সিস যদিও মৃত্যুবরণ করেছেন তথাপি তার পরিবেশ ও জলবায়ুকে রক্ষা আন্দোলনের সাথে বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলীও তীর্থযাত্রী।