ড. ফাদার লিটন হিউবার্ট গমেজ, সিএসসি
জীবন-জীবিকা ও প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষাবিষয়ক পোপ ফ্রান্সিসের ‘লাউদাতো সি’ নামক সর্বজনীন পত্রটির ১০তম বার্ষিকী উপলক্ষে ভাটিকানের সমন্বিত মানব উন্নয়ন নামক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২৪ থেকে ৩১ মে, ২০২৫ খ্রিস্টবর্ষে ‘লাউদাতো সি সপ্তাহ’ উদযাপন করা হচ্ছে। এ বছর প্রতিপাদ্য ‘ধরিত্রীর জন্য আশা জাগানো’ বিষয়টি অনুধ্যানে ধরিত্রী অবিরত অফুরন্ত আনন্দ বয়ে নিয়ে আসছে তা হৃদয়ে অনুধাবন করবো এবং আশাময় ভবিষ্যত বিনির্মাণে একসাথে কাজ করার মনোবল উজ্জীবিত করবো।
এই বছর ‘ধরিত্রীর জন্য আশা জাগানো’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে একত্রিত হবো এবং রোমীয় ৮:১৯-২৫ পদের আলোকে ‘আশার প্রথম ফসল’ প্রতীকটি আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে। পবিত্র বাইবেলে রোমীয়দের নিকট প্রেরিতশিষ্য সাধু পলের পত্রে, ধরিত্রীকে একজন মা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, প্রকৃতি আজ আর্তনাদপূর্ণ বিলাপ করছে, সৃষ্টি “প্রসব-বেদনায় গুমরে মরছে” (রোমীয় ৮:২২)। আসিসির সাধু ফ্রান্সিস তার সৃষ্টির বন্দনাগীতিতে বিষয়টি গভীরভাবে উপলদ্ধি করে ধরিত্রীকে আমাদের ‘বোন’ এবং আমাদের ‘মা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘প্রভু আমার, তোমার প্রশংসা হোক ভগ্নি পৃথিবীর জন্য, সে আমাদের জননী, সে করে আমাদের ধারণ ও ভরণপোষণ” (১২২৪ খ্রিস্টবর্ষ)।
যে ধরিত্রী আমাদেরকে লালন-পালন করছে, যে অঞ্চলে আমি বেড়ে উঠেছি, যে গ্রামে আমার শৈশব কেটেছে, যে বসতবাটিতে আমি জন্মেছি- সেখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশ কত অপব্যবহার ও কত দুর্ব্যবহারে আক্রান্ত। ধরিত্রীকে আমাদের প্রতি সৃষ্টিকর্তার উপহার হিসেবে বিবেচনা না করে, বরং একটি ভোগ্যপণ্য বা সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করছি। ধরিত্রীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করছি, আর ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি। তাই ধরিত্রী প্রসব-বেদনায় কাতড়াচ্ছে, সজোরে আর্তনাদ করছে। এ প্রসব-বেদনা জন্মের পূর্বলক্ষণ, এ আর্তনাদ ‘নবসৃষ্টির’ ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাইবেলের প্রেক্ষাপটে খ্রিস্টিয় আশা কৃত্রিম নয়, এটি সক্রিয়। আশা করা মানে স্থির থাকা ও শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নয়, বরং আর্তনাদে ব্যাকুল হওয়া এবং সংগ্রামের মধ্যে নবজীবনের জন্য সক্রিয় থাকা। আমাদের আশা ঈশ্বর বিশ্বাসে প্রোথিত, প্রতিশ্রুত এবং চারিদিকে ক্রিয়াশীল। তাই ‘লাউদাতো সি সপ্তাহ’ একটি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আশা এবং প্রত্যাশা করতে শেখায়। ঠিক যেমন প্রসব-সময়ে তীব্র যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে একটি নতুন জীবনের উদ্ভব হয়। তেমনি আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বা বৃহৎ ও মহৎ উদ্যোগ ও কর্মপ্রচেষ্টা প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীবন-জীবিকায় নবসৃষ্টি দান করবে।
‘লাউদাতো সি’ পত্রটির ৭টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের আলোকেআশা ও একত্রে কাজ করার কিছু উপলব্ধি ও কিছু সুপারিশ আলোচনা করা হলো, তবে পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের মতো করেও পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। ‘লাউদাতো সি’ সর্বজনীন পত্রটির ১০ম বার্ষিকী হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকে আরো দশজনকে জীবন-জীবিকা ও প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে সচেতনতা প্রদান করতে পারি।
১) জগতের আর্তনাদে সাড়াদান
জীবাশ্ম জ্বালানী ও নবায়নযোগ্য শক্তি অপচয়রোধ : জীবাশ্ম জ্বালানী হলো কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল অন্যদিকে নবায়নযোগ্য শক্তির মধ্যে রয়েছে সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, জলবিদ্যুৎ, ভূ-তাপীয় শক্তি এবং জৈব জ্বালানী। নিজের সৌখিন মনোবাসনাকে চ্যালেঞ্জ করে চাহিদা নয়, বরং প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে প্রাকৃতিক শক্তির অপচয় রোধ করতে পারি। একটু ভেবে দেখি, রাতে চাঁদ ও তারার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে কতবার বা কতক্ষণের জন্য ঘরের বাতিগুলো বন্ধ করে থাকতে পারি? এসি বন্ধ করে জানালা খোলে প্রাকৃতিক বাতাস ও আলো উপভোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিছুক্ষণ বন্ধ করে সরাসরি সামাজিক সর্ম্পকে থাকা এবং এরূপ বহুবিধ ছোট ছোট বাস্তবসম্মত চ্যালেঞ্জসমূহ নিজেকে করতে পারি এবং এতে করে উপরিউক্ত শক্তিসমূহের সুরক্ষা প্রদান করা যায়।
সবুজ জীবনধারা গ্রহণ: আগামী প্রজন্মকে সুন্দর ও সবুজ পরিবেশ উপহার দিতে নিজের দৈনন্দিন জীবনে কিছু অভ্যাস অনুশীলন অব্যাহত রাখা যায় । যেমন- নিজ বসতবাটি, স্কুল-কলেজ, অফিস, হাসপাতাল-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ধর্মপল্লী, ক্লাব ও সমিতি, ক্রেডিট ইউনিয়নের উপভোগ্য আঙ্গিনাটি বাগানে পরিণত করা এবং অনলাইন বা সরাসরি কর্মশালার মাধ্যমে পুনরুৎপাদনশীল কৃষি অর্থাৎ পরিবেশগত স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক সুফল ও সামাজিক সমতা অনুশীলন কৌশল সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা যায়।
২) দরিদ্রদের আর্তনাদে সাড়াদান
সমাজকে ক্ষমতায়ন করতে অঙ্গীকার : সামাজিক অসমতা ও বৈষ্যমের মূল কারণসমূহ মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ সমর্থন করা যায়। নিজের সময়, মেধা ও দক্ষতা ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ ও টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ করা ও পিছিয়ে থাকা সমাজের জনগণকে ক্ষমতায়ন করা যায়।
অব্যবহৃত সম্পদে সমাজ পুনরুজ্জীবিত: নিজের, স্কুলের, ধর্মপল্লীর, ক্রেডিট ইউনিয়নের, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের, কনভেন্টের ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত ভূমি বা জমি অথবা অন্যান্য সম্পদ ব্যবহার করা যায় এবং সমাজে পিছিয়ে থাকা ভাইবোনদের জন্য ব্যবহার করা যায়। নিজের উপার্জিত অবশিষ্ট অর্থ সঞ্চয় হিসেবে ক্রেডিট ইউনিয়নে জমা করতে পারি, অর্থাভাবে থাকা লোকজন ঋণ হিসেবে নিয়ে অর্থোপার্জনের খাত সৃষ্টি করতে পারে। সঞ্চয় করা, ঋণ গ্রহণ, উপার্জন করা এবং ঋণ ফেরত প্রদানটাও সিনোডভিত্তিক মণ্ডলী গড়ার একটি পন্থা।
৩) টেকসই জীবন-যাপন বেছে নেয়া
উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস গ্রহণ: খাদ্য তালিকায় মাংসের পরিমাণ কমানোর উপকারিতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিস্তর আলোচনা করে মাংস গ্রহণের পরিমাণ হ্রাস করা যায়। খাদ্য তালিকায় শাক-সবজির তৈরি খাবার বৃদ্ধি করা যায়। নিজের সুস্থ স্বাস্থ্যের বিষয়টি ধারণায় নিয়ে নিয়মিত নিরামিষ দিন উদযাপন করা যায়।
এককালীন ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকপণ্য বর্জ: প্লাস্টিক ও স্টাইরোফোম যা কফিকাপ, খাদ্য প্যাকিং তৈরিতে ব্যবহৃত হয়- তা ব্যবহার হ্রাস করাটা একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। যত্রতত্র প্লাস্টিক, বোতলজাত পানি ও টিস্যু ব্যবহার হ্রাস করা যায় কারণ এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস পাবে। এসবের বিপরীতে স্থানীয়ভাবে বিকল্প উপায় উদ্ভাবন করা যায় যা স্বাস্থ্য সুরক্ষার্থে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
৪) পরিবেশগত শিক্ষা বিস্তার
যুব-নেতৃত্ব: বাস্তুসংস্থান পুনর্নবীকরণে নেতৃত্ব দিতে তরুণ ও যুবকদের উৎসাহিত করা যায়। ‘লাউদাতো সি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে অংশীজনদের উদ্যোগকে সমর্থন করা, পুরস্কৃত করা ও স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে তাদের প্রচেষ্টার প্রভূত মূল্য দেওয়া যায়।
শিক্ষণ-প্রশিক্ষণে বাস্তুশাস্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজিক প্রশিক্ষণ কাঠামোতে মানবাধিকার, জলবায়ু, ন্যায্যতা ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক দায়দায়িত্ব প্রতিপালন নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন ও ‘লাউদাতো সি’ পত্রটি বিভিন্ন দেশে বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুরুত্ব দিয়েছে, আমাদের শিক্ষা পাঠ্যক্রমে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
৫) পরিবেশগত অর্থনীতি বিস্তার
স্থানীয় পণ্যসামগ্রী সমর্থন: স্থানীয় উৎপাদক ও ছোট ছোট কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া যায়। আঞ্চলিক অর্থনীতি ও পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব হ্রাস করতে ছোট ছোটি বিক্রেতাদের সাথে সরাসরি বেচাকেনার সম্পর্ক সৃষ্টি করা যায়।
টেকসই উপায় বাছাই: পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও টেকসই উৎস থেকে প্রাপ্ত উপকরণ দিয়ে তৈরি পণ্য বেছে নেওয়া যায়। এটি বর্জ্য নিষ্কাশন, কার্বন নিঃসরণ, সম্ভাব্য উপকরণ, কাঁচামাল, জ্বালানি-শক্তির ব্যবহার এবং বায়ু-জল দূষণ কমাতে পারে। নিজেদের এলাকায় এমন নীতি প্রচার ও প্রতিপালনের অভ্যাস অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণে সাহায্য করতে পারেন।
৬) পবিবেশগত আধ্যাত্মিকতা
আন্তঃধর্মীয় সংলাপ: পরিবেশগত এবং সামাজিক উদ্যোগ সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জনগণের সাথে আলোচনার ব্যবস্থা করা যায়। একে অপরের কাছ থেকে আরো নতুন নতুন পথ-পন্থা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা যায় এবং এভাবে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
আধ্যাত্মিক অনুশীলন: দলীয় প্রার্থনা, সহভাগিতা, বিশ্রামবার উদযাপন, নির্জনধ্যান ও বিশেষ খ্রিস্টযাগ আয়োজনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জীবনে ‘লাউদাতো সি’র মূলভাবগুলো অন্তর্ভুক্ত করা যায় যা স্থানীয় ঐতিহ্য ও পরিবেশগত উদ্যোগ গ্রহণের আগ্রহ বৃদ্ধি করবে। এ বিষয়ে যারা কাজ করছে তাদের জন্য প্রার্থনা করা এবং নিজের ত্যাগস্বীকারের কিছু অর্থ অনুদান হিসেবে প্রদান করা।
৭) সমাজকে সম্পৃক্তকরণ ও ক্ষমতায়ন
প্রকৃতি-পরিবেশবিষয়ক অ্যাডভোকেসি: জলবায়ু পরিবর্তেনের প্রভাব সম্পর্কে চিত্রাঙ্কন, পত্রিকা, লেখনি, সংবাদ পত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকলকে অবহিত করা। ‘ক্ষুদ্র পরিবেশবান্ধব সমাজ’ গঠন ক’রে ‘আমরা সবুজ, আমরা সুন্দর’ থাকতে বহুবিধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়।
গণমঙ্গল নীতিমালা তৈরি: সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের জন্য পরিবেশগত ও সামাজিক বিষয়সমূহ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে। স্থানীয় টেকসই পরিবর্তনের প্রত্যাশায় সুনির্দিষ্ট, পরিকল্পনা গ্রহণ, সমমনা অংশীজন ও বৃহত্তর সমাজের সাথে সংযুক্ত হতে হবে।
পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, তবুও, প্রতিটি ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও বৈশ্বিক তাপমাত্রায় দশমাংশের এক ডিগ্রি বৃদ্ধি এড়ানোটা অনেক মানুষের কিছু দুর্ভোগ কমাতে যথেষ্ট সহায়ক হবে। তিনি আরো বলেছেন- সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ব্যতীত কোনো স্থায়ী পরিবর্তন সম্ভব নয়, আবার ব্যক্তিগত পরিবর্তন ছাড়া কোনো স্থায়ী সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আসে না (লাউদাতো দেউম – ৭০)।
ল্যাটিন আমেরিকার বিশপীয় সম্মিলনীর সভাপতি এবং ভাটিকানের বিশপদের জন্য ডিকাস্ট্রির প্রিফেক্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে পরিবেশগত সংকটের অভিজ্ঞার আলোকে ধর্মগুরু পোপ লিও চতুর্দশ বলেছেন, “কথা থেকে কাজে” নামার সময় এখনই। আসুন, তারপরও বুঝতে চেষ্টা করি, যদিও পরিমানগত দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হয় আমাদের উদ্যোগসমূহ এখনই উল্লেখযোগ্য প্রভাব তৈরি করছে না তবুও সমাজের গভীরতর রূপান্তরশীল প্রক্রিয়া আনয়নে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করছে (লাউদাতো দেউম – ৭১)।