“তোমাদের হৃদয়ের আশা নম্রতার সাথে সহভাগিতা কর” (১ পিতর ৩:১৫-১৬)

প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
বর্তমান সময় নানাবিধ বিভ্রান্তি ও আদর্শগত বিচ্যূতি দ্বারা পরিপূর্ণ ও প্রভাবিত। তথাকথিত বাহ্যিক ক্ষমতা অভূতপূর্ব তথ্য ও তথ্যের বিশাল ভাণ্ডারকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই ধরণের পরিস্থিতিতে আমি সাংবাদিক ও যোগাযোগকারীদের সাথে তাদের কাজের গুরুত্ব সমন্ধে আলোচনা করতে চাই। জনগণের প্রতি আপনাদের ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত দায়িত্ব পালনের সাহসী প্রচেষ্টা অত্যন্ত প্রয়োজন।

পৃথিবীর সংকটময় সময়ে আমরা এই বছর যিশুর জন্মের ২০২৫ বছরের জুবিলী জয়ন্তী পালনকালে ঐশরীক অনুগ্রহ অনুভব করছি। আমি আমার এই বার্তায় আপনাদেরকে “আশার যোগাযোগকারী” হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। আশা করি, মঙ্গলসমাচারের চেতনায় আপনাদের কাজ ও প্রেরণ দায়িত্ব পুনর্নবায়ন করবেন।

যোগাযোগ নিরস্ত্রীকরণ (প্রতিশোধের পন্থা নয়)
বর্তমানে প্রায়শই যোগাযোগ আশা নয় বরং ভয়, হতাশা, কুসংস্কার, বিরক্তি, ধর্মান্ধতা এবং ঘৃণা তৈরির হাতিয়ার হয়ে উঠছে। অনেক সময় ঘৃণা উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে যোগাযোগ বাস্তবতাকে অস্বীকার এবং ক্ষুরধারার মতো শব্দকে ব্যবহার করে। যোগাযোগের মাধ্যমগুলো মিথ্যা ও শৈল্পিকভাবে বিকৃত তথ্য ব্যবহার করে জনগণকে উত্তেজিত ও উস্কে দেয় এবং আঘাত করে। বিভিন্ন সময়ে আমি বলেছি, যোগাযোগ প্রতিশোধ ও আক্রমণাত্মকতার জন্য যেন ব্যবহৃত না হয়। কারণ এই ধরণের যোগাযোগ কখনোই বাস্তবতাকে সাহায্য করে না। টেলিভিশন টকশো থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যমে মৌখিক আক্রমণের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতা, বিরোধিতা, আধিপত্য বিস্তার, অনধিকার চর্চা এবং জনমতের হেরফেরগুলো আরো স্পষ্ট হয়ে পড়ে।

আরেকটি উদ্বেগজনক ঘটনাও ঘটে। ডিজিটাল পদ্ধতির কারণে অন্যের প্রতি মনোযোগ স্থাপনে আমরা অনেক সময় ব্যর্থ হই এবং বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিবর্তিত হয়। ফলে অসহায় হয়ে পড়ি, অন্যের কল্যাণে এগিয়ে যাই না, অন্যের কথা শুনি না এবং অন্যকে বোঝার ক্ষমতাকে ক্ষুন্ন করে। আর এইভাবে নিজেকে জাহির করার জন্য শক্র তৈরি করি। যখন অন্যরা আমাদের শক্র হয়ে ওঠে তখন অন্যদের ব্যক্তিত্ব এবং মর্যাদাকে উপেক্ষা করে উপহাস করি এবং আশা তৈরির সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলি।

আশা আসলে সহজ কিছু নয়। ফরাসি লেখক ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক জর্জেস বার্নানোস বলেছিলেন, “কেবলমাত্র তারাই আশা করতে সক্ষম যারা মায়া ও মিথ্যাকে অস্বীকার করতে পারে”। আশা হলো একটি ঝুঁকি যা আমাদের প্রতিনিয়ত নিতে হয়। এটি ঝুঁকিরও ঝুঁকি। আশা হলো লুকানো মূল্যবোধ, গুণ এবং ধৈর্য। খ্রিস্টানদের জন্য আশা বিকল্প নয় বরং একটি প্রয়োজনীয় শর্ত। পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট ‘স্পে সালভি’ নামক প্রৈরিতিক পত্রে উল্লেখ করেছেন, আশা কোন নিস্ক্রিয় আশাবাদ নয় বরং একটি কার্যকর গুণ যা আমাদের জীবন পরিবর্তন করতে সক্ষম, “যার আশা আছে সে ভিন্নভাবে বাঁচে; যে আশা করে তাকে একটি নতুন জীবন উপহার হিসাবে দেওয়া হয়েছে” (২)।

নম্রতার সাথে আশাকে ব্যবহার
সাধু পিতরের প্রথম পত্রের ৩:১৫-১৬ অধ্যায়ে আশাকে আমরা খ্রিস্টিয় সাক্ষ্য ও যোগাযোগের সাথে যুক্ত হিসাবে দেখি, “তোমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রভুর, অর্থাৎ, খ্রিস্টের জন্যে পেতে রাখ শ্রদ্ধার আসন। অন্তরে তোমরা যে আশা লালন করছ, সেই আশার ভিত্তিটা কি, যখন যে কেউ তা জানতে আগ্রহী হোক না কেন, তোমরা তার উত্তর দিতে সর্বদাই প্রস্তুত থেকো। তবে উত্তর দিয়ো সবিনয়ে, সমুচিত সন্মান দেখিয়ে”। আমি তিনটি বাণীর ওপর আলোকপাত করতে চাই; আর এখান থেকে যোগাযোগের মধ্যে যে আশা বিদ্যমান তা জানতে পারবো।

প্রথম বার্তা হলো, তোমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রভু, অর্থাৎ, খ্রিস্টের জন্যে পেতে রাখ শ্রদ্ধার আসন”। খ্রিস্টানদের আশার মধ্যে পুনরুত্থিত প্রভুর মুখ নিহিত রয়েছে। পবিত্র আত্মার দানের মাধ্যমে আমাদের সাথে খ্রিস্টের থাকার প্রতিশ্রুতি সর্বদা নিরাশায় আশা এবং জীবনের সবকিছু হারিয়ে গেলেও মঙ্গলময়তা নিয়ে আসে।দ্বিতীয় বার্তা হলো, আমাদের মধ্যেকার আশা ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের সর্বদা প্রস্তুত থাকা উচিত। প্রেরিত শিষ্যরা বলেন, যে বা যারা আশা প্রত্যাশা করে তাদেরকে আশা প্রদান করতে হবে। খ্রিস্টানরা মূলত ঈশ্বরের “কথা বলার’ মানুষ নন বরং তাঁর প্রেমের সৌন্দর্য অনুভব করার জন্য নতুন উপায়ের কথা বলেন। আর জীবন্ত প্রেম একটি প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং উত্তরের আহ্বান জানায়: কেন তুমি এমনভাবে জীবনযাপন কর? কেন তুমি এমন?

সাধু পিতরের কথায় আমরা তৃতীয় বার্তাটি পাই, যেখানে প্রশ্নের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া যেন ‘ভদ্রতা ও শ্রদ্ধা’র সাথে হয় বলা হয়েছে। খ্রিস্টিয় যোগাযোগ অবশ্যই ভদ্রতা ও ঘনিষ্ঠতায় নিমজ্জিত হওয়া উচিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, রাস্তায় সঙ্গীদের সাথে যেমনভাবে আমরা কথা বলি। পুনরুত্থিত যিশুর এম্মাউসের পথে দু’জন শিষ্যের সাথে হাঁটা, কথোপকথন এবং শাস্ত্রের আলোকে তাদের হৃদয় জ্বালিয়ে ঘটনার ব্যাখ্যাকরণ একজন উত্তম যোগাযোগকারীর পন্থা ও উদাহরণ হতে পারে।
আমি এমন একটি যোগাযোগের স্বপ্ন দেখি যা ভাইবোনদের সহযাত্রী করে একসাথে হাঁটতে এবং এই অস্থির সময়ে তাদের মনে আশার সঞ্চার ঘটাতে পারে।

আমি চাই এমন একটি যোগাযোগ গড়ে উঠুক যা প্রতিরক্ষামূলক ও ক্রোধের আবেগপূর্ণ প্রতিক্রিয়া নয় বরং একে অপরের হৃদয়ের সাথে কথা বলতে সক্ষম, খোলামেলা এবং বন্ধুত্বের মনোভাব জাগিয়ে তুলে। এমন একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠুক যা হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যে সৌন্দর্য এবং আশার ওপর মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম। যোগাযোগ হবে এমন যা প্রত্যেক মানুষকে মর্যাদার স্বীকৃতি দিতে এবং আমাদের বসতবাটি এই পৃথিবীকে যত্ন নিতে একসাথে কাজ করবে (ডিলেক্সিট নং ২১৭)।

আমি এমন একটি যোগাযোগের স্বপ্ন দেখি যা বিভ্রান্তি বা ভয় প্রচার করে না, বরং আশার সঞ্চার ঘটায়। মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন, “যদি আমি কাউকে সাহায্য করতে পারি, কাউকে একটি শব্দ বা গান দিয়ে উৎসাহিত করতে পারি তাহলে আমার জীবন বৃথা যাবে না”। তবে এটি করার জন্য আমাদের আত্মপ্রচার ও আত্মমগ্ন রোগ থেকে নিরাময় হওয়া দরকার এবং নিজের কথা অন্যকে চিৎকার করে শোনানোর প্রবণতা পরিত্যাগ করতে হবে। একজন উত্তম যোগাযোগকারী অবশ্যই অন্যের কথা শুনে, কাছে আসে এবং ঘনিষ্ঠ হয়। এইভাবে যোগাযোগ বর্তমান জুবিলীর মূলভাব “আশার তীর্থযাত্রী” হতে সাহায্য করে।

সমন্বিত আশা
আশা সব সময় একটি সামাজিক প্রকল্প। আসুন আমরা অনুগ্রহপূর্ণ এই জুবিলী বর্ষের বাণীর মহিমা সম্পর্কে একবার ভাবি। আমরা সকলে নতুনভাবে শুরু করি এবং ঈশ্বরের করুণা ও আলিঙ্গন লাভের জন্য আমন্ত্রিত। এই ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত এবং দলীয় দিকগুলো অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত: আমরা ভাইবোনদের সাথে যাত্রা করে পুণ্যদ্বার দিয়ে প্রবেশ করি।

জুবিলীর অনেক সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা কারাগারে বসবাসকারীদের জন্য করুণা ও আশার বার্তা অথবা যারা কষ্টভোগ করে এবং প্রান্তিক অবস্থায় রয়েছে তাদের প্রতি ঘনিষ্ঠতা এবং কোমলতার আহ্বান সম্পর্কে ভাবতে পারি। জুবিলী আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, যারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করে তাদের “ঈশ্বরের সন্তান বলে ডাকা হবে” (মথি ৫:৯) এবং এইভাবে এটি আশাকে অনুপ্রাণিত করে ও মনোযোগী, মৃদু ও প্রতিফলিত যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তার দিকে নির্দেশ করে; আর এগুলো সংলাপের পথ নির্দেশ করতে সক্ষম। এই কারণে আমি আপনাদের সোনা-অনুসন্ধানকারীদের মতো অক্লান্তভাবে বালি ছেঁকে সোনার টুকরো বের করার মতো খবরের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা ভালো গল্প আবিষ্কার ও প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত করছি।

আশার পথ খুঁজে বের করা এবং সেগুলো অন্যকে জানানো দরকার; কারণ তা দরিদ্রদের কান্না শুনতে, অন্যের প্রতি উদাসীন না হতে ও নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়া থেকে দূরে রাখে। আপনারা সর্বদা ভালোর ঝলক খুঁজে বের করুন যা আমাদের আশান্বিত হতে অনুপ্রাণিত করে। এই ধরণের যোগাযোগ সম্প্রীতি গড়তে ও অন্যের সাথে একত্রে চলার গুরুত্ব পুনরায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করতে পারে।

মানুষকে ভুলে যেও না
প্রিয় ভাই ও বোনেরা প্রযুক্তির বিস্ময়কর সাফল্যের সময়ে আমি তোমাদের হৃদয় ও জীবনের কথা ভাবতে ও যত্ন নিতে উৎসাহিত করছি। আসলে এই কথার অর্থ কী? আমি তোমাদের ভাবনার জন্য কিছু বলি। নম্র হও এবং যাদের সেবা করার জন্য তোমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাদের কথা কখনো ভুলে যেও না। তাদের হৃদয়ের কথা বুঝতে চেষ্টা কর। তোমাদের আবেগ দ্বারা যোগাযোগকে পরিচালিত হতে দিও না। সব সময় আশা ছড়িয়ে দাও; এমনকি যখন জীবন কঠিন সমস্যায় নিমজ্জ্বিত এবং শুভফল আসে না তখনও নিরাশাগ্রস্থ হইয়ো না। এমন যোগাযোগ প্রচার করার চেষ্টা করো যা আমাদের সমাজ ও মানবতার সমস্যা নিরাময় করতে পারে।

অপ্রতিরোধ্য ফুলের মতো হৃদয়গ্রাহী বিশ্বাসের প্রতি গুরুত্বারোপ কর। জীবন ধ্বংসকারীর কাছে নতিস্বীকার করো না, বরং অপ্রত্যাশিত জায়গায় প্রস্ফুটিত হয়ে বেড়ে উঠ। আশায়পূর্ণ মায়েদের মতো হতে হবে, যে মা প্রতিদিন প্রার্থনা করে যেন তার সন্তান সংঘাত থেকে ফিরে আসে। উন্নত জীবনের আশায় ঝুঁকি নিয়ে যে বাবা দেশ ত্যাগ করে সেই বাবার মতো আশা থাকতে হবে। আমাদেরও হতে হবে যুদ্ধাক্রান্ত শিশুদের মতো যারা যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে যে কোনভাবে রাস্তায় খেলতে, হাসতে এবং জীবনে বাঁচার পথ খুঁজে বের করতে সক্ষম।

আক্রমণাত্মকহীন যোগাযোগের সাক্ষী ও প্রবর্তক হয়ে উঠুন। যত্নের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে, সম্পর্কের সেতু নির্মাণ, বর্তমান সময়ের দৃশ্য ও অদৃশ্য সেতু ভেঙ্গে ফেলতে সাহায্য করুন। আশার গল্প বলুন, জনসাধারণের ভাগ্য সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হোন এবং সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণে একসাথে কাজ করুন।

ঈশ্বরের অনুগ্রহে জুবিলী বর্ষে আমরা একত্রে এই সকল কাজ বাস্তবায়ন করতে পারি। আর এটাই হলো আমার প্রার্থনা। আপনাদের ও আপনাদের কাজের প্রতি প্রার্থনাপূর্ণ আশির্বাদ।

রোম, সাধু জন লাটেরান বাসেলিকা, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সাধু ফ্রান্সিস দ্যা সালসের স্মরণ দিবস

পোপ ফ্রান্সিস

ভাষান্তর: ফাদার সাগর কোড়াইয়া

Please follow and like us: