বিশপ জের্ভাস রোজারিও

আমরা সকলেই জানি খ্রিস্টাব্দ হচ্ছে যিশুখ্রিস্টের জন্মের বর্ষগণনার কাল। খ্রিস্টের জন্মের পরে আমরা ২০২৫ বছর পার হয়ে এসেছি। প্রয়াত পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস গত বছর এই বছরটিকে একটি বিশেষ পুণ্যবর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। সেই জন্যই কাথলিক মণ্ডলীতে এই বছরটি পালিত হচ্ছে খ্রিস্টজয়ন্তী বা জুবিলী বর্ষ হিসাবে। আর এই জয়ন্তী বা জুবিলীবর্ষের মূলভাব হলো “আমরা আশার তীর্থযাত্রী”। তাই আমরা ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ বছরব্যাপী বিভিন্নভাবে আশার তীর্থযাত্রী হওয়ার চেষ্টা করছি।

এই বছর সারা পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ খ্রিস্টভক্ত পুণ্যনগরী রোম ও জেরুশালেমে তীর্থযাত্রা করতে যাচ্ছে। বিশেষভাবে রোম নগরীতে জুবিলী বা খ্রিস্টজয়ন্তীর বিভিন্ন দলের জন্য অনেক কর্মসূচী হাতে নেওয়া হয়েছে ও তা সম্পন্ন হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের অসংখ্য পুণ্যার্থী এইসব অনুষ্ঠানে যোগদান করছে ও পুণ্য প্রসাদ ও প্রশান্তি নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশ থেকেও অনেকে সেই পুণ্যনগরে গিয়ে তীর্থ করার সুযোগ পাচ্ছে।

বাংলাদেশের আরও অনেক খ্রিস্টভক্ত আশা করছে সেখানে গিয়ে তীর্থে অংশ নেওয়ার। কিন্তু নানা কারণে সম্ভব হয় নাই বা হচ্ছে না। অনেকে আবার অর্থনৈতিক কারণে অথবা অন্য কারণের জন্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তীর্থ করতে যেতে পারছে না। তবে তীর্থ উদ্যাপন করতে সব সময় যে রোম নগরীতে বা বিদেশের কোন তীর্থস্থানে যেতে হবে, এমন নয়। আমরা আমাদের নিজ নিজ দেশে বা এলাকায় থেকেও একইপ্রকার তীর্থ পালন করতে পারি। তীর্থের বিষয়গুলো হলো, পাপস্বীকার ও পাপের প্রায়শ্চিত্ত, উপবাস, মন পরিবর্তন, খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করে খ্রিস্টপ্রসাদ গ্রহণ, দয়া ও ভালবাসার কাজ করা। আমরা এইগুলো নিজস্ব ধর্মপল্লী অথবা ক্যাথেড্রাল গির্জায় অথবা দেশের ভিতরে কোন তীর্থস্থানে গিয়েও করতে পারি।

এই বছর আমাদের তীর্থের মূলভাব হলো “আশার তীর্থযাত্রী” অর্থাৎ “আমরা আশার তীর্থযাত্রী”। এখন প্রশ্ন হলো আমরা কিসের আশা করি? আমাদের অনেক আশা রয়েছে। আশা তখনই করা যায় যখন বিশ্বাস থাকে। বিশ্বাসযোগ্য না হলে আমরা কোন কিছু আশা করতে পারি না। যেমন আমরা যখন অসুস্থ হই, তখন আমরা ডাক্তারের কাছে যাই এবং ঔষধ খাই। এটা করি কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে ঔষধ খেলে সুস্থ হব। আমরা আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ার আশা করি, তার জন্য পরিশ্রম করি। পরীক্ষায় পাশ করার আশা করে যদি কোন ছাত্র পড়াশুনা না করে তাহলে সে কিভাবে পাশ করবে? তাহলে দেখা যাচ্ছে যে বিশ্বাস করলেই আমরা আশা করি আর আশা করি বলে আমরা কিছু পরিশ্রমের কাজও করি। সেই পরিশ্রমের কাজ হলো, ত্যাগস্বীকার, প্রায়শ্চিত্ত, কৃচ্ছতাসাধন, ধ্যান-প্রার্থনা ও মনপরিবর্তন।

জগতে আমাদের অনেক জাগতিক আশা রয়েছে, যার হয়তো কিছু পূর্ণ হয় আবার কিছু আশা পূর্ণ হয় না। আমাদের আশা পূর্ণ হবে কি হবে না তা নির্ভর করে আমরা সেই আশা পূরণের জন্য কতটা একাগ্র ভক্তি বা পরিশ্রমের কাজ করেছি। তবে আমরা জাগতিক আশা পূরণের জন্য যত পরিশ্রমই করি না কেন, তা পূর্ণ হতেও পারে নাও পারে। কিন্তু আমাদের একটি চুড়ান্ত আশা আছে, আমরা চাই যেন তা অবশ্যই পূর্ণ হয়। যদি তা না হয় বৃথা হয়ে যাবে আমাদের ধর্মবিশ্বাসের জীবন। আমাদের সেই চূড়ান্ত আশা হলো যে, এই জাগতিক জীবনের শেষে আমরা একদিন অনন্ত সুখের এক স্বর্গীয় জীবন পাব। আমারা বিশ্বাস করি ঈশ্বর আমাদের জন্য যেমন মর্ত্য সৃষ্টি করেছেন তেমনি তিনি আমাদের জন্য স্বর্গও সৃষ্টি করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি এই জীবনের শেষে একদিন আমরা স্বর্গে যাব। সেইজন্যই তো এই ধর্মীয় ও ভক্তিবিশ্বাসের জীবন যাপন করছি! সেই স্বর্গীয় জীবনে আমরা অনন্ত সুখে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে ও যিশুর সঙ্গে থাকব। আমাদের আর থাকবে না কোন কষ্ট বা পরীক্ষা প্রলোভন।

সেই জীবনে যেতে হলে আমাদের অবশ্যই পুণ্য সঞ্চয়ের কাজ করতে হবে- ঈশ্বরকে ভালবাসতে হবে সমস্ত অন্তর দিয়ে, মন-প্রাণ দিয়ে ও শক্তি দিয়ে আর প্রতিবেশী ভাইবোনদের ভালবাসতে হবে নিজের মত করে। আমরা আমাদের বাবা-মা, ভাই-বোন, পরিবারের সকল আত্মীয়, কাছের বা দূরের প্রতিবেশী মানুষ, পরিচিত বা অপরিচিত সকল মানুষ; বিশেষভাবে অতিদরিদ্র ও প্রতিবন্ধী, শিশু ও প্রবীণ ও যাদের কথা কেউ ভাবে না তাদেরকে নিজের মত ভালবাসতে হবে। নিজেকে তো আমরা ভালইবাসি, ঘৃণা করি না বা বঞ্চিত করি না, কষ্ট দেই না, প্রতারণা করি না বা ঠকাই না। তাহলে প্রতিবেশীদেরও সেইরকমই ভালবাসতে হবে; কম কিছু নয়।

আমরা আশার তীর্থযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে চাই, কিন্তু কিভাবে? এই বছর আমরা যা করতে পারি তা হলো: পরিবারে ও ধর্মপল্লীতে আমরা প্রার্থনায় নিয়মিত হব, ধর্মীয় ও ঔপাসনিক অনুষ্ঠানগুলোতে যোগদান করব, পরিবারে ও বাইরে ভালবাসা বা দয়ার কাজ করব, সকলের সঙ্গেই সুসম্পর্ক ও সদ্ভাব বজায় রাখব, মণ্ডলীর পালকীয় কাজে সহায়তা করব বা সেইসব কাজে অংশ নিব, মণ্ডলীকে আর্থিকভাবে সহায়তা করব ঠিক যেমন মণ্ডলীর পঞ্চম আজ্ঞায় বলা আছে। সৎ জীবন যাপন ও নৈতিক আদর্শে জীবন যাপন করে খ্রিস্টের শিক্ষা সকলের কাছে প্রচার করব আর সম্ভব হলে বাণী প্রচারের জন্য কাজ করব। আমরা বৃহৎ আকারে কিছু করতে না পারলেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবেও এই কাজগুলো করে এবারের তীর্থযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারি। তীর্থযাত্রায় আমাদের অংশগ্রহণ যদি আন্তরিক, সৎ ও সুন্দর হয়, তাহলে তা ক্ষুদ্র হলেও আমরা ঈশ্বরের বৃহৎ পুরষ্কার পাব। সেই পুরষ্কার হলো অনন্ত সুখের স্বর্গলাভ। এই বছর সকলের তীর্থবাসনা বা মনের আশা পূরণ হোক।

Please follow and like us: