বিশপ জের্ভাস রোজারিও

বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫০ কোটি অনুসারী সম্বলিত কাথলিক মণ্ডলীর আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিক জীবন এমন কিছু ঐতিহ্য বা রীতি-নীতির ওপর স্থাপিত যা দুই হাজার বছরের পুরনো। কাথলিক মণ্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ সকল আইন বা নিয়ম-নীতি পবিত্র বাইবেল ও মঙ্গলসমাচারে যিশুর শিক্ষা অনুসারেই তৈরী হয়েছে। এর মধ্যে একটি ঐতিহ্য হলো যে, শুধু পুরুষরাই যাজক হিসাবে অভিষিক্ত হতে পারবে। কাথলিক মণ্ডলীতে এই বিষয়টি যাজকীয় পদ ও সংস্কারীয় ঐশতত্ত্বের সঙ্গে এমনভাবে বয়ন করা যে তা প্রথম থেকেই অপরিবর্তনীয় বলে গণ্য করা হয়ে আসছে। তবে যাজকীয় পদে শুধু পুরুষদের অভিষিক্ত করার এই রীতিটি সম্পর্কে অনেকেই বর্তমানের সমসাময়িক সামাজিক ও লিঙ্গ সমতার আলোকে চ্যালেঞ্জ করে আসছে।

বর্তমানেও নারীরা কেন যাজকপদের অভিষিক্ত হতে পারবে না, এই নিয়ে অনেক বিতর্ক ও আলোচনা চলছে। তবে কাথলিক মণ্ডলীতে শুধুমাত্র পুরুষরা যাজক পদে অভিষিক্ত হলেও এটা নারীদের কোনভাবেই তাদের মানব মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুন্ন করে না। বরং এটি নর ও নারীর পারস্পরিক নির্ভরশীল ভূমিকাকেই তুলে ধরে। সৃষ্টির সময় থেকেই ঈশ্বর নর ও নারীর জৈবিক, নৈতিক ও সামাজিক ভূমিকা স্থির করে দিয়েছেন যা বদল করা সম্ভব নয়। পবিত্র শাস্ত্র ও ঐতিহ্য থেকেই কাথলিক মণ্ডলী এই শিক্ষা দিয়েছে যে মণ্ডলীতে পুরুষ ও নারীর মানবিক মর্যাদা সমান, যদিও তাদের ভূমিকা আলাদা।

ঐশতাত্ত্বিক ভিত্তি
শুধু পুরুষরাই যাজকপদে অভিষিক্ত হবে, এই রীতিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কারণ যিশু তাঁর যে ১২জন শিষ্য বেছে নিয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন পুরুষ। যিশু যে শুধু পুরুষদেরই তাঁর শিষ্য নিয়োগ করেছিলেন, এর কারণ শুধু সামাজিক বা কৃষ্টি-সাংস্কৃতিকই নয় বরং এটা তিনি ইচ্ছা করেই করেছেন। এর মূল কারণ হলো ঐশতাত্ত্বিক। কাথলিক মণ্ডলীতে পুরোহিত বা যাজক হলেন অপর খ্রিস্ট এবং তিনি যিশুর হয়ে সেবাকাজ করেন, আর যিশু ছিলেন পুরুষ। কাথলিক মণ্ডলীর ধর্মশিক্ষা বইয়ে বলা হয়েছে: “খ্রিস্ট কর্তৃক এই স্বীকার করে নিতে মণ্ডলী বাধ্য বলে নিজেকে বিবেচনা করে। এই কারণেই মহিলাদের পদাভিষেক (যাজকত্ব) সংস্কার দেওয়া সম্ভব নয়” (কাথলিক মণ্ডলীর ধর্মশিক্ষা- ১৫৭৭)

পারস্পরিক লৈঙ্গিক পরিপূরকতা
কাথলিক মণ্ডলী শিক্ষা দেয় যে নর ও নারীর মানবিক মর্যাদা ও সম্মান সমান, কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে তাদের ভূমিকা আলাদা, যা আবার পরস্পরের পরিপূরক। এই বিশ্বাসটি আদিপুস্তকে সৃষ্টিকাহিনীতে বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে ঈশ্বর তাঁর নিজের প্রতিমূর্তিতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, “পুরুষ ও নারী করেই তিনি তাদের সৃষ্টি করেন” (আদি ১:২৭)। পুরুষ ও নারীর আলাদা আলাদা লিঙ্গ ঈশ্বরের বিভিন্ন স্বরূপ প্রকাশ করে, এবং সেগুলো একত্রে প্রকাশ করে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি।

নর ও নারীর স্বতন্ত্র ভূমিকার কারণে তারা কেউ কারো চেয়ে বড় বা ছোট নয়, তারা উভয়েই সমান। কিন্তু তাদের স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করে তারা একজন আর একজনকে পূর্ণতা দান করে। এটা হলো ঈশ^রের পরিকল্পনা অনুসারে একপ্রকার ঐক্যতানময় অংশীদারিত্ব। কাথলিক মণ্ডলীতে পুরুষদের যাজকত্বকে এই ঐশরিক পরিকল্পনারই অংশ বলে মনে করা হয়, এটা যেন খ্রিস্ট হলেন স্বামী, আর মণ্ডলী হলো তাঁর স্ত্রী (এফেসীয় ৫:২১-৩৩)। এই বৈবাহিক প্রতীকটি নারী ও পুরুষের ব্যক্তি সম্পর্ক তাদের পরিপূরকতার গুরুত্ব প্রকাশ করে। তারা আর একা বা আলাদা নয় বরং তারা প্রকৃতিগতভাবেই পরস্পরের সহযোগি, সহভাগি ও পরস্পরের পরিপূরক।

নারীর মর্যাদা ও ভূমিকা
মণ্ডলী ও সমাজে নারীদের অনন্য ভূমিকার জন্য কাথলিক মণ্ডলী নারীদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে এবং তাদের সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। কাথলিক মণ্ডলীতে যে একজন মানব ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো হয়, তিনি হলেন যিশুর মা মারীয়া; যিনি একজন নারী। তিনি যিশুর মা, তাই তিনি ঈশ^রের মা। মারীয়ার ভূমিকা উচ্চে তুলে ধরে নারীর পূর্ণ মহিমা; নারীত্বের অন্তর্নিহিত গুণাবলী প্রকাশ পায় তার সন্তানের জন্ম ও যত্ন, তার বুদ্ধি-বিবেচনা এবং তার জীবনদায়ী ক্ষমতার মধ্যে। মারীয়ার “ফিয়াৎ” বা নির্দ্বিধায় ঈশ্বরের ইচ্ছা মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে সকল খ্রিস্টবিশ্বাসী নারী ও পুরুষ সকলের আদর্শ হয়ে আছেন।

গোটা ইতিহাসের মধ্যেই মণ্ডলীতে নারীর ভূমিকা ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। যিশুর প্রথম সঙ্গীদের মধ্যে কিছু নারী ছিল যারা যিশুর প্রচার কার্যের সহযোগী ছিলেন। যেমন লাজারের বোন মার্থা ও মারিয়া, মারীয়া মাগ্দালেনা , যোহান্না ও যাকোবের মা মারিয়া। আদি মণ্ডলীতেও যিশুর শিষ্যদের বাণী প্রচার কাজে ও মণ্ডলী পরিচর্যা কাজে নারীরা সহযোগিতা করেছে। আভিলার সাধ্বী তেরেজা, সিয়েনার সাধ্বী কাতারিনা এবং লিজিউর বালক যিশুর ভক্তা সাধ্বী তেরেজা নারী হলেও তারা মণ্ডলীর সম্মানিত “ডক্টর” বা আচার্য্য লাভ করেছেন। তাঁরা তাদের জীবন ও শিক্ষার দ্বারা কাথলিক মণ্ডলীর আধ্যাত্মিকতা ও ঐশতত্ত্বের ওপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন। মণ্ডলীর সেই প্রথম থেকেই ধর্মব্রতিনী ও খ্রিস্টভক্ত নারীরা কাথলিক মণ্ডলীর বিভিন্ন অঙ্গনে যেমন, শিক্ষাদান, স্বাস্থ্যসেবা, সমাজসেবা, ন্যায্যতা ও শান্তি স্থাপন ও বাণীপ্রচার সেবাকাজে প্রভূত অবদান রেখে চলেছেন। মণ্ডলী সব সময়ই তাঁদের এইসব অবদানকে উচ্চে স্থান দেয় এবং সম্মানের সঙ্গে স্বীকৃতি দেয়। কারণ তাঁদের এইসব অবদান পৃথিবীতে খ্রিস্টের বাণীপ্রচার ও সাক্ষ্যদানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মাতৃত্ব ও পিতৃত্ব
কাথলিক মণ্ডলী বিশ্বাস করে যে, অন্য প্রাণীদের মতই মানব লিঙ্গও পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের সঙ্গে জড়িত। এটাই নারী ও পুরুষ হিসাবে পরিচয়ের মূল বিষয়। আমরা কেউ এই জৈবিক বাস্তবতাটি বদল করতে পারি না। জৈবিক বা আধ্যাত্মিক যাই হোক না কেন, মাতৃত্ব সর্বদাই ধারণ করে সেবা-যত্ন, মায়া-মমতা এবং গভীর ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষমতা। এই গুণাবলীগুলোকে মণ্ডলী মনে করে সমাজ জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ও অপূরণীয়। মানব ব্যক্তির পিতৃত্ব ধারণ করে তার সুরক্ষা দান, পরিচালনা করা ও ত্যাগস্বীকারপূর্ণ নেতৃত্ব। এই গুণাবলীগুলো যাজকদেরও রয়েছে, যার কারণে তাঁদের ডাকা হয়, “ফাদার” বা “পিতা” বলে। যাজকদের আহ্বান হলো তাঁদের অধীনে ন্যস্ত জনগণের আধ্যাত্মিক পিতা হওয়া এবং তাদের পরিচালনা দান করা। তাদের ত্যাগস্বীকারপূর্ণ নেতৃত্ব হবে খ্রিস্টের নেতৃত্বেরই মত, যা হবে ভালবাসা ও সেবা দানের জন্য, কোন কিছুর বিনিময়ে নয় বরং নিস্বার্থভাবে।

একটি ভুল ধারণার জবাব
সমালোচকেরা বলে থাকে যে নারীদের যাজকত্বের পদাভিষেক না দেওয়ার ফলে তাদের মর্যাদা ও লিঙ্গ সমতা ক্ষুন্ন হয়; নারীরা যাজকত্ব পায় না বলে তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা হয়। যারা এরূপ ভাবে তারা কিন্তু মণ্ডলীর ঐশতত্ব বুঝে না বা বুঝতে চায় না। মণ্ডলী এটা কখনোই শিক্ষা দেয় না যে পুরুষ নারীর চেয়ে বড়; আর এটাও মণ্ডলী শিক্ষা দেয় না যে নারীর ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ। মণ্ডলী বরং সর্বদাই শিক্ষা দিয়ে আসছে যে পুরুষ ও নারীর মানবীয় মর্যাদা সমান। পুরুষ ও নারীর মর্যাদা সমান হলেও তাঁদের ভূমিকা আলাদা- যা সমানভাবে মূল্যবান ও পরস্পরের পরিপূরক।

প্রয়াত সাধু পোপ ২য় জন পল তাঁর প্রৈরিতিক পত্র “মুলিয়েরিস্ দিগ্নিতাতেম” (১৯৮৮) বা “নারীর মর্যাদা” নামক দলিলে জোর দিয়ে বলেছেন যে নারী ও পুরুষের মর্যাদা ও মূল্য সমান। তিনি বলেছেন, ঈশ্বর উপহার হিসাবেই মানব জাতির জন্য দিয়েছেন নারীকে। বিশ্বে ও সমাজে নারীর অনন্য অবদান মানব সভ্যতাকে সমুন্নত ও সুন্দর করেছে। তিনি বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলেন, লিঙ্গের ওপর মণ্ডলীর শিক্ষা নারী ও পুরুষের পার্থক্যকে সম্মান করে কারণ তা মানব সম্পর্ক ও সমাজকে সমৃদ্ধ করে।
পুরুষ যাজকত্বের ওপর কাথলিক মণ্ডলীর উপরোক্ত শিক্ষা স্পষ্টতই বলে দেয় যে, এতে নারীর মর্যাদা ক্ষুন্ন না হয়ে বরং নারী-পুরুষের পার্থক্যের কারণেই নারীর যাজকাভিষেক সম্ভব নয়।

মণ্ডলী নারী ও পুরুষ সম্পর্কে এই মতাদর্শ উচ্চে তুলে ধরে এই কারণে যে, নারী ও পুরুষের পার্থক্য ঈশ্বর নিজেই সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের উভয়কেই ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন তাঁর নিজের প্রতিমূর্তিতে। সময়ের সঙ্গে বিশ্বে ও সমাজে বিবর্তন হচ্ছে, সব কিছুতে পরিবর্তনও আসছে, কিন্তু মণ্ডলী তাঁর এই চিরন্তন সত্য বিশ্বাস সমুন্নত রেখে চলেছে। মোট কথা, নারী ও পুরুষ তাদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকারে সমান; কিন্তু তাদের ভূমিকা আলাদা আলাদা। কোন অজুহাতে নারীকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো অন্যায্যতা ও পাপ।

তবে দুঃখজনক হলো যে, পৃথিবীর অনেক দেশের মত আমাদের বাংলাদেশেও দেখা যায় উল্টো চিত্র। এখানে নারীকে পদে পদেই তার অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয়। নারীকে পদানত করে রাখা হয় যেমন পরিবারে তেমন সমাজে। স্থানীয় মণ্ডলীতেও তার ব্যতিক্রম নয়। এই অবস্থার পরিবর্তন আসতে হবে আর এই পরিবর্তনের জন্য শিক্ষা ও গঠন দরকার যেখানে মণ্ডলী শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। এই বিষয়ে সমাজ, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও মন-মানসিকতার পরিবর্তন হতে হবে। তবে সবার আগে পরিবর্তন আসতে হবে পারিবারিক সম্পর্ক ও মানসিকতার মধ্যে। স্থানীয় মণ্ডলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ পালকীয় সেবাকাজ হবে পরিবারকে এই শিক্ষা ও গঠন দেওয়া।

 

Please follow and like us: