সিরিজ  

ভোরের আলো তখনো ফোটেনি, ঘুম জড়ানো চোখে আমি দাদার হাত ধরে রওনা দিতাম। ঠান্ডা বাতাসে কাঁপা কাঁপা শরীর, কিন্তু দাদার উষ্ণ হাত ছিল আশ্বাসের মতো। পায়ের নিচে শিশির ভেজা ঘাস, মাথার উপর তখনো থমকে থাকা চাঁদের আলোয় চারপাশে ছায়া আর আলোয় গাঁথা এক অপার্থিব জগৎ—সব মিলিয়ে এক রহস্যময় দৃশ্যপট। দুরুদুরু বুকে কালি বাড়ি পেরিয়ে, বাঁশঝাড়ের ফাঁক গলে গির্জার পথে হাঁটা ছিল যেন এক অনন্ত যাত্রার অংশ—ঐশ্বরিক আলোর পথে যাত্রা।

গির্জার মূল ফটকে প্রতিদিন একজন বিদেশি ফাদার বসতেন একটি ছোট টুলে। সামনে সাজানো হতো যিশু, মারিয়া, সাধু যোসেফ ও অন্যান্য সাধু-সাধ্বীর ছবি। হাতে তুলে দিতেন একটি করে ফটোকপি, শিশুদের মুখে ছিল এক আশ্চর্য উল্লাস—কে বেশি ছবি সংগ্রহ করতে পারবে, কে পুরস্কার পাবে! সেই প্রতিযোগিতা ছিল সরল অথচ গভীর। ধর্মীয় চর্চার অভিজ্ঞতা, বিশ্বাসের বীজ, আর শিশুমনস্তত্ত্বের এক চমৎকার মেলবন্ধন।

সিরিজ

শিশু মঙ্গল সংঘের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ঘোষণা হতেই মা আমার গান শেখার প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায়, যখন মা লাকড়ির চুলায় রান্না করতেন, চুলার আগুন মাঝে মাঝে চমকে উঠতো, ঠিক তখন আমার গলায় চলতো গান। চুলার আলো, আগুনের ঝলক, আর মায়ের স্নেহময় মুখ—এ এক পবিত্র মিলনস্থল। গান ছিল আমাদের আত্মিক বন্ধন। মা রান্না করতেন, আর আমি গাইতাম।

প্রতিযোগিতার দিন আমি গান গাইলাম। আমার কণ্ঠে ভেসে উঠেছিলো সেই সব সন্ধ্যার চর্চা। ১ম পুরস্কার হিসেবে পেলাম একটি “গীতাবলি” গান বই। শিশুমনের জন্য তা যেন ছিলো এক ধনভান্ডার। মায়ের মুখে যে আনন্দের ছায়া দেখেছিলাম সেদিন, তা এখনো হৃদয়ে জ্বলজ্বল করে। এটা শুধু পুরস্কার ছিল না, আমার আত্মবিশ্বাসের জন্মক্ষন।

সিরিজ

ছেলেবেলায় সিনেমার গান ছিল আমার নেশা। মাজাহারুল ইসলামের কণ্ঠে রেডিওর ১৫ মিনিটের সিনেমার বিজ্ঞাপন যেন আমাকে অন্য জগতে নিয়ে যেত। গরুর জন্য ঘাস কাটতে যাওয়ার পথে বা লাকড়ি কুড়াতে বের হলে আমি জোরে জোরে গান ধরতাম। আশেপাশের বাড়ির মানুষ কেউ কেউ ধমক দিত, কেউ হাসতো। কিন্তু গান আমার ভেতরের আলো ছিল, যা সব কিছু পেরিয়ে বের হয়ে আসতো।

সিরিজ  

আমার বয়স তখন মাত্র ১২, ৮ম শ্রেণিতে পড়ি। মা মারা গেলেন। প্রথমে বুঝতেই পারিনি আমি কেমন অনুভব করবো। চারপাশের মানুষ মায়ের স্মৃতিকে বারবার টেনে আনতো। আমার আচরণ, হাসি, দুষ্টামি—সব কিছুর বিচার হতো এক দৃষ্টিকোণ থেকে: ‘মা নেই’

একদিন এক সহপাঠী বললো,

“তোর মা মরেছে, তাও তুই দুষ্টামি করিস?”

সেই কথা আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। আমি বুঝতে পারতাম না—আমি কি খুব বেশি স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছি? আমার কি চুপচাপ থাকাই উচিত? সেই থেকে আমি নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতে থাকি।

আমি সংকুচিত হয়ে গেলাম। মানুষের সামনে আসা বন্ধ করলাম। এক অদৃশ্য দেয়াল গড়ে উঠলো আমার চারপাশে।

মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণে এটি ছিল ‘কম্প্লেক্স গ্রিফ রিঅ্যাকশন’। আমি শোক প্রকাশ করতে পারছিলাম না, আবার সেটা চেপে রাখতে গিয়েও সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় ভুগছিলাম। কাউন্সেলিং দরকার ছিল, দরকার ছিল সহানুভূতির। কিন্তু আমি পেয়েছিলাম বিচারের চোখ।

সিরিজ  

হোস্টেলে গিয়ে হারমোনিয়াম পেলাম। আমি তন্ময় হয়ে বাজাতে শিখলাম, চোখ বন্ধ করে গান তুলতাম। গির্জায় গান গাইতাম হৃদয়ের গভীর থেকে। একদিন কেউ বললো, ‘ছাগলের মতো চিৎকার করে গান করিস কেন?’ এই এক কথায় আমার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল। মনোবিজ্ঞানে এটাকে বলে ‘ট্রমা রেসপন্স’—আমরা যেটা ভালোবাসি, যেটাতে আত্মা জড়িয়ে থাকে, তা নিয়ে কেউ হাসলে, অপমান করলে সেটা হৃদয়ের গভীরে আঘাত করে। আমি গান ছেড়ে দিলাম। হারমোনিয়াম বাজাতে পারি এখনো, কিন্তু গলা যেন আটকে যায়।

সিরিজ  

কিন্তু জীবন থেমে থাকেনি। একজন রেক্টর আমার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এলেন। তিনি আমাকে বিভিন্ন দায়িত্ব দিলেন—সেমিনারির দোকানের দায়িত্ব, চ্যাপেলের দায়িত্ব, খাবার টেবিল সাজানো, ফুড মিনিস্টার। সেই দায়িত্ব আমাকে আবার জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনলো। মানুষের সাথে যোগাযোগ, নেতৃত্ব, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা—all came alive. আত্মবিশ্বাস ফিরে এল ধীরে ধীরে।

এটা ছিলো এক ধরণের ‘থেরাপিউটিক এক্সপোজার’—যেখানে আমার ট্রিগার বা ভয়ের জায়গাগুলোকেই ধীরে ধীরে আত্মস্থ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরলাম, এমনকি স্বপ্ন দেখতে শিখলাম।

সিরিজ

আজ আমি মানুষ চিনি। মুখাবয়ব দেখে মনের ভাষা পড়তে পারি। অনেকেই আমাকে এখনো ‘নিরীহ’, ‘বোকা’ ভাবেন। কিন্তু আমার কাজ, দক্ষতা দেখে চমকে ওঠেন। তাদের কণ্ঠে দ্বিধা, চোখে বিস্ময়। এটা ‘কগনিটিভ ডিসোন্যান্স’—যেখানে বাস্তবতা আর তাদের ধারনা মেলেনা।

সিরিজ  

আজ আমি ঈশ্বরকে প্রতিটি পদক্ষেপে অনুভব করি। তিনিই আমার পিতা, আমার আশ্রয়। কেউ আমাকে অপমান করতে চেয়েছে, তিনি রক্ষা করেছেন। আমার প্রয়োজন হলে তিনি কাউকে না কাউকে পাঠিয়েছেন।

আমি জানি, আমি তাঁর পরিকল্পনার অংশ। আমি আহত হয়েছি, আবার সুস্থ হয়েছি। আমার জীবন যেন এক আত্মিক, মনস্তাত্ত্বিক, সাহিত্যিক যাত্রা—যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে ঈশ্বরের উপস্থিতি আছে।

আমার গল্প কেবল আমার না—এটা সেইসব মানুষদের যারা ভাঙা থেকে গড়ে উঠে, যারা ভালোবাসা আর স্বীকৃতি না পেয়ে নিজেই নিজের আলো জ্বালায়।

Please follow and like us: