আব্রাহাম এক্কা

 প্রতিটি মা-বাবা চান তার সন্তান মানুষের মত মানুষ হয়ে উঠুক; ভাল পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক। পিতা-মাতার দায়িত্ব পালন ও সমাজের মানুষের সেবা করুক। পিতা-মাতাগণ সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, সন্তানকে স্বপ্ন দেখান; আর এ স্বপ্নকে বাস্তবে রুপদিতে গিয়ে পিতা-মাতাকে সন্তানের চাহিদাপূরণে নিজের সাধালাধ জলাঞ্জলি দিতে হয়, ত্যাগস্বীকার করতে হয় এবং সচেতনভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা আবশ্যক। কিন্তু প্রশ্নো হলো আমরা পিতা-মাতাগণ কি আমাদের সন্তানদের গড়ে তোলার জন্য সচেতনভাবে দায়িত্বপালনে করছি? নাকি গড্ডারিকা প্রবাহের মতো গা ভাসিয়ে চলছি! আমরা যদি আমাদের খ্রিস্টীয় সমাজের দিকে দৃষ্টি দেই তাহ’লে দেখি প্রতিবেশী হিন্দু-মুসলিম পিতা-মাতাগণ তাদের সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে, কাঙ্খিত স্বপ্নপূরণে সচেনভাবে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নেন, সন্তানের যত্ন নেন, সন্তানের শিক্ষাখরচ যোগাতে আর্থিক পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। ফলে তাদের সন্তানগণ আশানুরুপ ফলাফল করছে এবং বিভিন্ন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারী-বেসরকারী উচ্চ পদে চাকুরী করছেন। সেই বিবেচনায় আমাদের খ্রিস্টান সমাজের সন্তানদের অবস্থান কোথায়? কি অবস্থায় আছে এবং কেন? এর কারণ ভেবে দেখার সময় হয়েছে বৈকী। একাধিক কারণ আমরা চিহ্নিত করতে পারবো। কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত নাইবা করলাম।

পারিবারিক, সামাজিক তথা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বা সার্বিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও ভয়াবহ। প্রায় প্রতিটি পরিবারে সন্তানেরা সহজ এবং অবাধ মোবাইল ফোন ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে এই অবুঝ শিশুরা বাইরে মাঠে খেলা, পড়ালেখা এমনকি সময়মত খাওয়ার পরিবর্তে সারাক্ষণ মোবাইল ফোন ব্যবহার করচ্ছে। ফলশ্রুতিতে মোবাইলের প্রতি শিশুদের চরম আসক্তি জন্মেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে শিশুদের মধ্যে বিরুপ প্রভাব পড়বে, পড়াশোনায় অনীহা-অমনোযোগী, বিকৃত মনোবৃত্তি সৃষ্টি হবে, মস্তিষ্ক বিকল হয়ে পড়বে, শিশুরা মেধাশূণ্য হবে এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

যদি আমরা মনেপ্রাণে চাই আমাদের সন্তানেরা আদর্শ, সুশিক্ষিত মানবিক গুণাবলী নিয়ে, ধর্মীয় অনুশাসনে বেড়ে উঠুক; তাহলে এখনি সময় নিম্নোক্ত পদক্ষপ নেয়া জরুরী:    

* সন্তানকে নিয়ে খেলাধূলায় সময় দেয়া: প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিৎ সন্তানকে খেলা-ধূলা করার সুযোগ করে  দেয়া, সময় করে বাইরে খেলতে নিয়ে যাওয়া। ফলে সন্তান শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকশিত হবে এবং মোবাইল ব্যবহারের আসক্তি থেকে বিরত থাকতে সহায়ক হবে।

* শিশুসন্তান নিয়ে আত্নীয় বাড়ি বা বাইরে ঘুরতে-বেড়াতে যাওয়া: শিশুসন্তানকে সংগে নিয়ে আত্নীয় বাড়ি বেড়াতে, বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে এতে শিশু অনেক আনন্দ পাবে, আত্নীয়-স্বজনদের সাথে পরিচিত ও সম্পর্ক তৈরী হবে।

* সন্তানের সাথে শিক্ষণীয় গল্প বলা: বিভিন্ন সাধু-সাধ্বী, মহৎ ব্যক্তিবর্গের জীবনী, পবিত্র বাইবেলে উল্লিখিত নৈতিক ও আত্মিক অনুপ্রেরণাদায়ক চরিত্র নিয়ে সন্তানের সাথে শিক্ষণীয় গল্প বলা। গল্প থেকে কি শিক্ষালাভ করলো সে বিষয়ে ছোট ছোট প্রশ্নো জিজ্ঞেস করা।

*      সন্তানকে নিয়ে পড়াশোনায় বসানো: সকাল-সন্ধা নিয়মিত সন্তানকে পড়তে বসানো, শিক্ষক কর্তৃক প্রদত্ত বাড়ির কাজ সম্পন্ন করতে এবং ক্লাসের পড়া প্রস্তুত করতে সহায়তা করা।

* শিশুসন্তানকে বিভিন্ন গল্পের বই পড়তে অনুপ্রাণিত করা: শিশুসন্তানকে অবসরে নৈতিক গঠণমূলক ধর্মীয় ও শিক্ষনীয় বই পড়তে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করুন। ফলে শিশু সন্তানের মধ্যে নৈতিকতা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে, পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়বে।

* সন্তানকে পারিবারিক রোজারি মালা প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করানো: প্রতিদিন সন্ধায় শিশুসন্তানকে নিয়ে পারিবারিক রোজারিমালা প্রার্থনা করবেন এবং পড়তে পারলে তাদের দিয়ে পবিত্র বাইবেল পাঠ করাবেন।  এতে শিশুদের অন্তরে ঈশ্বর ও যিশুর প্রতি বিশ্বাস-ভক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং ছোট থেকেই প্রার্থনার প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং প্রার্থনাশীল মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে।

* সন্তানকে ছঁবি আঁকতে উৎসাহিত করা: প্রায় সবশিশুই ছঁবি আঁকতে ও রং করতে বেশ মজা ও আনন্দ পায়। তাই শিশুর জন্য বিভিন্ন ছবি সম্বলিত বই সাথে রং পেন্সিল সরবরাহ করুন। ছঁবি অংকনের মধ্য দিয়ে শিশুর মধ্যে সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা, দরদবোধ ও প্রকৃতি প্রেমিক উদার মনের মানুষে পরিণত হবে।

*  সন্তানকে দিয়ে ফুলের ও সবজি বাগান করানো: উঠানের খালি জায়গায় অথবা ছাদের টবে শিশুদের দ্বারা ফুলের বাগান ও সবজি বাগান করান। যাতে করে শিশুরা প্রতিদিন নিয়ম মাফিক বাগানের যত্ন ও পরিচর্যা করতে পারে এভাবে শিশুমনে ভালোবাসা এবং সুকোমল মনোবৃত্তি লাভ করবে ।

*  সন্তানকে  নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া: ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা সন্তানকে ছোট থেকেই দেয়া অত্যাবশ্যকীয়। এই শিক্ষার মাধ্যমে শিশুসন্তানদের মধ্যে ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা, নৈতিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধ সৃষ্টি হবে, একজন ভালো মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে।

*  সন্তানকে শারীরিক ও মানসিক যত্ন নেয়া: শিশুসন্তান যেন শারীরিক ও মানসিকভাবে পরিপূর্ণভাবে মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে সেই জন্যে পিতা-মাতার উচিৎ তাদের সন্তানদের শারীরিক-মানসিক যত্ন নেয়া, যেন তারা সুস্থ্যশরীর ও  সুস্থ্যমন-মানসিকতা নিয়ে বড় হয়।

* পিতা-মাতাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে সংযমী হওয়া: শিশু সন্তানদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারী করার পূর্বে পিতা-মাতাগণকে মোবাইলফোন ব্যবহারে হতে হবে সংযমী ও সচেতন।

*  সঙ্গীত শিক্ষায় শিশুদের উৎসাহ প্রদান ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে সুযোগ সৃষ্টি করা: শিশু সন্তানদের নাচ, গান, কবিতাবৃত্তি ও বাদ্যযন্ত্র শেখায় উৎসাহিত ও সুযোগ করে দেয়া এবং সাংস্কৃতিক ও অন্যন্য প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করণে সুযোগ সৃষ্টি করা অভিভাবকদের বিশেষ দায়িত্ব। ফলে সন্তানের মধ্যে একঘেয়েমী দূর হবে, অন্তর গভীরে আনন্দবোধ জাগ্রত হবে, ভয়ভীতি, হীনমন্নোতা থাকবে না,  সকলের সাথে সহজে মিসার সক্ষমতা তরান্বিত হবে।

* সন্তানকে পারিবারিক ছোট ছোট কাজে সম্পৃক্ত করা: ছোট ছোট পারিবারিক কাজে সন্তানকে সম্পৃক্ত করা যেমন বিছানা পাড়া, ঘর ঝাড়ু দেয়া, রান্না কাজে মাকে সাহায্য করা (ছেলে-মেয়ে উভয়ই)। এতে তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও অংশগ্রহণ তৈরী হবে। একই সাথে পিতা-মাতার সাথে সন্তানের হ্রদয়তা সৃষ্টি হবে তথা সম্পর্ক নিবিড় ও মধুর হবে। পারস্পারিক ভালোবাসা, সন্মান ও শ্রদ্ধাবোধ বিরাজ করবে।

*  সন্তানকে ব্যক্তিগত পরিস্কার-পরিছন্নতা ও পয়:নিস্কাশন বিষয়ে ধারণা প্রদান করা: সন্তানদেরকে সুস্থ্য-সবল পরিপাটি ও রোগমুক্ত রাখতে হলে তাদেরকে ব্যক্তিগত পরিস্কার-পরিছন্নতা ও পয়:নিস্কাশন বিষয়ে সচেতনতাদান করা/শিক্ষা দেয়া গুরুত্বপূর্ণ।  ফলে তাদের মধ্যে এব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধিপাবে এবং বিভিন্ন রোগবালাই থেকে রক্ষা পাবে।

*  শিশুসন্তানকে দিয়ে বাড়ীতে মাটি দিয়ে বিভিন্ন ফল, ফুল, পশু-পাখি তৈরী করানো: এতে করে সন্তানদের মনে সৃষ্টিশীলতা তৈরি হবে, মাটির সংস্পর্শে আসবে, মা-মাটি মানুষের প্রতি হৃদয়ের সম্পর্ক তৈরি হবে।

*  রবিবাসরীয় অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সন্তানকে অংশগ্রহণ করানো: সন্তানদের রবিবাসরীয় অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করানো প্রতিটি পিতা-মাতার গুরুদায়িত্ব ও কর্তব্যও বটে । সন্তানগণ নিজ ধর্ম সম্পর্কে জানবে, শিশুমনে ধর্মকর্ম করার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে, সর্বোপরি  রবিবাসরীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাল-পুরোহিতগণের উপদেশবাণী জীবনগঠনে অবদান রাখবে।

*  সন্তানকে আদর ভালোবাসা ও শাসন করা: সন্তান যেন আদর ভালোবাসা ও শাসনের মধ্য দিয়ে আদর্শ মানব সন্তান হিসেবে একজন ভালো ব্যক্তিত্ববান মানুষ রুপে বিকশিত হয়, বেড়ে উঠে। পিতা-মাতাগণ যদি তাদের সন্তানকে কোন প্রকার শাসন না করেন অন্ধভাবে আদর ভালোবাসা দেন, তবে সন্তান হয়ে উঠবে উশৃঙ্খল, বেপরোয়া, অবাধ্য ও স্বেচ্ছাচারি। তাই প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিৎ তাদের সন্তানকে যথাযথভাবে প্রয়োজনানুযায়ী শাসন করা ও আদর ভালোবাস দেয়া। রবি ঠাকুরের ভাষায়,”শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে।”

*  সন্তানকে বাইরের খাবারের পরিবর্তে বাড়িতে তৈরী খাবার খেতে দিন: আজকাল বাইরের ফাস্টফুড খাবার খাওয়া শিশুদের নিকট ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। ফলে তারা ঘরে তৈরি স্বস্থ্যসম্মত খাবারের প্রতি অনীহা ও বাইরের খাবারের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। বাইরের অস্বাস্থ্যকর নিম্নমানের খাবার খেয়ে সন্তানরা অসুস্থ্য ও বিশেষক্ষেত্রে স্থুল আকার ধারণ করছে। তাই প্রতিটি মায়েদের উচিৎ আপনার সন্তানকে বাইরের খাবার খায়ানো বন্ধ করে বাড়িতে নিজ হাতে তৈরি গুণগত মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যকর খাবার দেন এবং খেতে অভ্যাস করুন। এতে টাকাও বাঁচবে এবং গুণগত মানসম্পন্ন খাবার খেয়ে শিশু স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

*  শিশুসন্তানদের পর্যাপ্ত ঘুমানোর ব্যবস্থা করা: শরীর-মন সুস্থ্য সবল ও সতেজ রাখার জন্য নিবিড়-পর্যাপ্ত  ঘুমের কোন বিকল্প নেই। তাই প্রত্যেক পিতা-মাতাদের সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিৎ তাদের সন্তান যেন সময়মত পর্যাপ্ত সময় নিয়ে ঘুমাতে পারে।

আমার একান্ত ব্যক্তিগত চিন্তা থেকে ও কয়েকজন অভিভাবকদের মতামতের ভিত্তিতে এই লেখাটি প্রস্তুত করেছি। আমার বিশ্বাস প্রতিটি পরিবারে পিতা-মাতাগণ যদি উপরোল্লিখিত পরামর্শগুলোসহ আরোও অন্যান্য পদক্ষেপ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে আন্তরিকতার সাথে বাস্তবায়ন করেন তাহ’লে ইতিবাচক ফলাফল পাবেন। প্রতিটি মানব সন্তান মানব সম্পদে পরিণত হবে।

Please follow and like us: