ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিবেদক, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
মিডিয়াকে বলা হয় সমাজের দর্পন, সমাজের বিবেক, জনগণের শিক্ষক। মিডিয়ার বদৌলতে এই গ্রহটি এখন একটি বিশ্ব পল্লী হয়ে উঠেছে। মানুষ বুঝুক বা না বুঝুক, প্রতি নিয়ত সে মিডিয়ার দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। তাই আজকের দিনে মিডিয়ার ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো জো নাই। এটা জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। জনগণের মতামত গঠন, গণ সচেনতা তৈরি, দেশের উন্নয়ন ও সরকারের নীতি সম্পর্কে অবগত হওয়া, দেশ বিদেশের খবর জানা, খেলাধুলা, সুস্থ বিনোদন, ইত্যাদি সবই গণমাধ্যমের ভ‚মিকা। মিডিয়ার আরো একটি বড় ভূমিকা হলো, সমাজের অন্যায্যতা, অপশাসন ও দুর্বল দিকগুলো তুলে ধ’রে সরকারকে সহায়তা করা। সেই জন্য মিডিয়াকে বলা হয় গণতন্ত্রের চর্তুথ পিলার।
দেশের গণমাধ্যম নিয়ে আজকাল বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। আসল প্রশ্নটা হলো- দেশে এতো প্রিন্ট সংস্কারণ পত্রিকা, এতো অনলাইন সংস্করণ পত্রিকা, এতো অনলাইন নিউজ পোর্টল ও এতো আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) টেলিভিশন কেনো ? এছাড়া প্রাইভেট টেলিভিশন, কমিউনিটি রেডিও, এফ.এম. রেডিও এবং অনলাইন রেডিও তো আছেই। দেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত গণমাধ্যমের সংখ্যা কত তার সঠিক হিসাব দেওয়া আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন সুত্র থেকে সংখ্যার যে হিসাব দেওয়া হয় সেখান থেকে একেবারে সঠিক চিত্র পাওয়া না গেলেও অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, এই সংখ্যা দেশে গণমাধ্যম ভোক্তাদের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। এক সুত্রে বলা হয়েছে যে, দেশে তিন হাজারের অধীক পত্রিকার মধ্যে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ১,২৭৭টি। অন্যদিকে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিকগুলোর সংখ্যা না হয় বাদই দিলাম। আবার সব মিলিয়ে অনলাইন গণমাধ্যমের সংখ্যা নাকী ১০ হাজারের বেশি। এই সংখ্যার মধ্যে একটা সংখ্যা আবার প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। যেগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এগুলোর উদ্দেশ্য প্রণোদিত রিপোর্টে যে মাঝেমধ্যে দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হচ্ছে, তার অনেক অভিযোগ আছে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বরের বিভিন্ন পত্রিকায় অনিবন্ধিত ও অনুমোদনহীন সব অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধে আদালতের নির্দেশনার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ১৮ সেপ্টেম্বরের কিছু দৈনিকের খবর ছিলো- তথ্য মন্ত্রণালয় ৯২টি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংস্কারণ এবং ৮৫টি অনলাইন পত্রিকার নিবন্ধন দিয়েছে। এছাড়া নিবন্ধনের জন্য এক হাজার ৭৩২টি অনলাইন পত্রিকার আবেদন, তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। গণমাধ্যম নিয়ে আদালতের নির্দেশনার পর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অনলাইন মিডিয়া নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। মিডিয়া নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী অবৈধ অনলাইন মিডিয়া বন্ধ ও নিবন্ধনের কথা বলেছেন। কতোগুলো অনলাইন পোর্টালের আবেদন রয়েছে এই প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, “চার হাজারের মতো আবেদন জমা আছে।” ইউটিউব চ্যানেলে মানুষের চরিত্র হনন ক’রে কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে, এই প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, “অনলাইন যেভাবে রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছি তেমনিভাবে ইউটিউব বা আইপি টিভিও রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করব। ব্যাঙের ছাতার মতো আইপি টিভি করার হিড়িক পড়ছে, এটি কোনোভাবেই সমীচীন নয়।” সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে মন্ত্রী বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের মত প্রকাশের অবারিত সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে; একই সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সমাজে নানা ধরনের অস্থিরতা তৈরি, সরকার ও ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর সুযোগ হিসেবেও এটির ব্যবহার লক্ষণীয়।” এগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা আনার বিষয়টি মন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। ওটিট (OTT- Over-The-Top) প্ল্যাাটফর্ম নিয়েও ড. হাছান মাহমুদ শৃঙ্খলা আনার আশ্বাস দিয়েছেন। (ওটিটি হলো এক ধরণের গণমাধ্যম সার্ভিস, সেগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরাসরি দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে পারে)। এগুলো ছাড়াও ইন্টারনেটভিত্তিক অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) কারবারিরা কল সেন্টারের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আসা কল ডাইভার্ট করে সরকারের প্রচুর রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় এইসব অবৈধ ভিওআইপি চক্রের বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে সরকার অভিযান চালালেও এদের নিমূর্ল করা সম্ভব হয়নি।
পত্রিকা বা যে কোনো মিডিয়াতে কোনো কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচারের প্রধান উদ্দেশ্য হলো জনগণকে অবগত করা। আর একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখনোও মনে করে যে, যেহেতু বার্তাটি প্রচার করা হয়েছে তাই এটা সত্য। কিন্তু আসলেই কী তাই ? আজকে প্রযুক্তি এতো নিখুঁত যে ছয়-নয় করা কোনো সমস্যা নয়। মিডিয়ার এডিটরিয়াল পরিসি অবশ্যই সুস্থমানের হতে হবে। আর একটি বিষয় হলো- মিডিয়ার কোনো শাখারই উচিৎ নয় পাবলিক হয়রাণি করা। কিন্তু বাস্তবে উল্টো। ইন্টারনেটে বা ফেইসবুকে কোনো খবর বা বিষয় জানতে চাইলে বরাবরই বিজ্ঞাপনের ঝামেলায় পড়তে হয়। একটা পর একটা বিজ্ঞাপন পদার্য় এসে বিরক্তিকর অবস্থা তৈরি করে। এগুলো দেখা বা প্রতিবাদ করার লোক নেই কেনো ? কেনো কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই ? অবৈধ ও অনিবন্ধিত হাজার হাজার অনলাইন মিডিয়া বন্ধ হলে এইসব বিজ্ঞাপনের ঝামেলাও কমে আসবে।
অনিবন্ধিত পত্রিকা এবং ইন্টারনেটভিত্তিক মিডিয়া ও নিউজ পোর্টালগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আদালত থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অবৈধ আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) টেলিভিশন নিয়েও আদালত থেকে হুকুম দেওয়া হয়েছে। এছাড়া লাগামহীন সোস্যাল মিডিয়ার দায়িত্বহীন প্রচার বন্ধের জন্যও সরকার তৎপর হয়ে উঠেছেন। গণমাধ্যমের অপতৎপড়তা ও অপসংস্কৃতি বন্ধের জন্য সরকারের উদ্যোগ একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ গ্রহণকে সরকারের মিডিয়া দমন নীতি বলা যাবে না। গণমাধ্যম ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নয়, সেচ্ছাচারের জন্য নয়, কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নয়, এমকি সামাজিক স্টেটাস বৃদ্ধি করাও নয়।
দেশের মূলধারার পত্রিকা নিয়ে অনেকের অভিযোগ হলো- বিনোদনের পাতায় বিদেশী সিনেমার এতো অনৈতিক খবর কেনো ? তারকাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এতো অনৈতিক খবর ও পারিবারিক জীবন নিয়ে এতো নটখটির মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় কী আছে ? কেনো এগুলো ফলাও করে পত্রিকার পাতায় ছাপাতে হবে ? পত্রিকা কী শুধু বড়রাই পড়েন নাকী অন্যেরাও পড়ে ? আজকের যুবসমাজ পত্রিকার বিনোদন পাতা থেকে কী শিক্ষা লাভ করছে ? অথবা এইসব খবর যুবসমাজের মধ্যে অবক্ষয় তৈরি করছে কীনা ? বিদেশী সিরিয়াল নিয়ে নতুন কিছু আর বলার নেই। নৈতিক অবক্ষয় রক্ষার জন্য নারী নির্ভর এইসব সিরিয়াল বন্ধের পক্ষে সচেতন নাগরিক সমাজ বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উত্থাপন করলেও বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিশ্বের বৃহৎ ধর্ম ইসলাম এবং খ্রিস্টধর্মের শিক্ষানুসারে এগুলো জায়েজ নয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও এইসব সিরিয়ালের অপসংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গত ২৩ সেপ্টম্বর খবরের কাজকে প্রকাশিত একটি খবর ছিলো এইরকম- ভারতীয় মেঘাসিরিয়াল “সিআইডি” দেখে সিলেটের একটি এটিএম বুথে ডাকাতি করার কৌশল শেখে। পত্রিকায় বলা হয়েছে, চক্রটি ব্যাংকের সিসি ক্যামেরায় কালো স্প্রে মেরে অদৃশ্য করে বুথ থেকে ২৪ লাখ টাকা লুটের পর ১৪ লাখ টাকা জুয়া খেলে উড়িয়ে দেয়। তাহলে ভেবে দেখুন- বিষয়টি কতোটুকু উদ্বেগের। মিডিয়া যদি মানুষকে শিক্ষিত না করে অবৈধ পথে ঠেলে দেয়, তবে সেই মিডিয়ার প্রয়োজন কতোটুকু ? ইন্টারনেট ও ডিজিটাল মিডিয়ার কারণে, মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া, প্রতারণা অনেক বেড়ে গেছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় নেতা, সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক নেতা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়ার অনুরোধ রইলো।
সবশেষে সংবাদপত্র নিয়ে একটা ছোটো গল্প বলে লেখা শেষ করতে চাই। শ্রেণিকক্ষে একজন ছাত্রকে শিক্ষক জিজ্ঞেস করেছিলেন, বলো তো সংবাদপত্র দিয়ে কী করা হয় ? উত্তরে ছাত্রটি বলেছিলো, স্যার, সংবাদপত্র দিয়ে ঝালমুড়ি খাওয়ার ঠোংগা বানানো হয়। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।