ডানিয়েল লর্ড রোজারিও
“ভাই জানো,আমার পুলাডা আগে প্রতিদিন নেশা আর জুয়া খেলে নিজের সব ট্যাহা  নষ্ট কইরা হালাইতো  আর বাইত্যে  অনেক অশান্তি করত। এমন কোন দিন বাদ নাইকা  যে মদ খাইতো না। আমি খালি যিশুরে কইতাম আমার পুলাডারে তুমি বালা কইরা দেও। আশ্চর্যের বিষয়  এ্যাহোন আমার পোলায় আর কোন নেশা করে না প্রতিদিন রোজা করে আবার মিশায়ও যায়।ওর কামের ট্যাহায় আংগো সংসার চলে” অনেক ভালো লাগছিল যখন মা তার সন্তানের পরিবর্তনের কথাগুলো সহভাগিতা করছিল। তার মুখে একটা আলাদা প্রশান্তির ছাপ লক্ষ্য করছিলাম আর মনে মনে চিন্তা করছিলাম এটাই বুঝি বর্তমানে যিশুর পুনরুথান। বর্তমান বাস্তবতায় পৃথিবীতে নানারকম সমস্যা বিরাজমান আর আমরা সকলেই তা থেকে মুক্তি চাই। আর যিশু সত্যি আমাদের সকল অশান্তি থেকে মুক্তি দিতেই মৃত্যুবরণ করেছেন এবং পুনরুথিত হয়েছেন।
“খ্রিস্ট সকলের হয়ে এই জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন, যাতে যারা জীবিত, তারা যেন নিজেদের জন্য আর জীবন যাপন না করে, বরং যিনি তাদের হয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন ও পুনরুত্থিত হয়েছেন, তারা যেন তারই জন্য জন্যে জীবন – যাপন করে।”(২ করিন্থীয় ৫:১৫)অনেক সময় আমরা নিজেদের অহমিকাকে অন্তরে ধারণ করে জীবন- যাপন করি। আমরা ভুলে যাই আমাদের বিশ্বাসের মূলে কি ছিল। পুনরুথান উৎসব আমাদের কী স্মরণ করিয়ে দেয়?
‘পুনরুত্থান ‘ উৎসবটির হিব্রু পাস্কা বা নিস্তার পর্বের সাথে মিল রয়েছে। পুরাতন নিয়মে পাস্কা হলো দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করা।প্রতিশ্রুত দেশে প্রবেশের যাত্রা, মুক্তি ও স্বাধীন মানুষ এবং নাগরিক হওয়ার প্রত্যাশায়। পবিত্র নতুন নিয়মে পাস্কা হলো পাপের দাসত্ব ও মন্দতা থেকে মুক্তি লাভ করা। এক কথায়,পাস্কা হলো পার হয়ে যাওয়া বা অতিক্রম করা। মুক্তি লাভের পথ ও আদর্শ হলেন স্বয়ং যিশু খ্রিস্ট। যিনি সকল পাপের জন্য ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে কষ্ট – যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে মৃত্যুবরন করেছেন এবং মৃত্যুকে জয় করে পুনরুত্থিত হয়েছেন। সাধু পল পুনরুত্থিত খ্রিষ্টের বিষয়ে বলেন; “খ্রিস্ট যদি পুনরুত্থিত না হয়ে থাকেন তাহলে আমাদের প্রচারও বৃথা তোমাদের বিশ্বাসও বৃথা”( ১ করি ১৫:১৪)। ইহুদীদের পর্বটি নিস্তার পর্ব বা passover নামে পরিচিত।নিস্তার শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো, রক্ষা বা রেহাই পাওয়া, বিপদ বা মন্দতা থেকে রক্ষা পাওয়া। সর্বোপরি, নিস্তার পর্ব হলো ইশ্বরের সহায়তায় উদ্ধার পাওয়া। লাতিন Pascha, গ্রীক paskha এবং হিব্রু pesakha ও ইংরেজি Easter resurrection শব্দ ব্যবহার করা হয়। তবে পাস্কা বা পুনরুথান আমাদেরকে সত্য ও আলোকময় পথের সন্ধান দেয়, চিরন্তন পিতার রাজ্যে প্রবেশের লক্ষ্যে।
খ্রিস্টের পুনরুথান আমাদের আশা প্রদান করে। আমরা খ্রিষ্টের পুনরুথানে বিশ্বাসীভক্ত।তিনি আমাদের মুক্তির রুপকার। যখন আমরা মৃত্যুন্জয়ী খ্রিস্টের সহায়তায় আমাদের পাপময়তাকে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হই, তখনই আমাদের মধ্যে পুনরুত্থিত যিশুর শক্তি কাজ করে। খ্রিস্টের পুনরুথান আমাদের শিক্ষা দেয় যে,আমাদের কষ্ট ও মৃত্যু বৃথা যাবে না। যিশুর পুনরুথান প্রকাশ করে যে, ভালবাসা পাপ ও মৃত্যুর চেয়ে বেশী শক্তিশালী।” কোন কিছুই আমাদের প্রভু যিশুখ্রিস্টে নিহিত ঐশ ভালোবাসা থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না ; মৃত্যু নয়, জীবনও নয়, কোন দূত, আধিপত্য বা শক্তি, বর্তমান বা ভবিষ্যতকালের কোন কিছু, উর্ধ্ব বা অতলের কোন প্রভাব, কিংবা সৃষ্ট অন্য কোন কিছুই নয়” ( রোমীয় ৮:৩৯)।
পুনরুত্থান পর্বের মাধ্যমে আমরা পুনরুত্থিত খ্রিস্টের দুটি দিক নিয়ে চিন্তা করি। প্রথমত, “তার মৃত্যু দ্বারা খ্রিস্ট আমাদের মুক্ত করেছেন; তার পুনরুত্থান দ্বারা তিনি আমাদের কাছে নব জীবনের পথ উন্মুক্ত করেছেন। এই নতুন জীবন পরমেশ্বরের অনুগ্রহে আমাদের ধার্মিক বলে পুন:প্রতিষ্ঠিত করেছেন,’ মৃতদের মধ্য থেকে খ্রিস্টকে যেমন পিতার গৌরব দ্বারা পুনরুত্থিত করা হয়েছে তেমনি আমরাও যেন জীবনের নীরবতায় চলতে পারি’। ধার্মিকতার অর্থ দ্বিবিধ : পাপের কারণে যে মৃত্যু এসেছে তার উপর বিজয়ী হওয়া এবং অনুগ্রহে নতুন ভাবে অংশগ্রহণ”( কাথলিক মন্ডলীর ধর্মশিক্ষা, ধারা, ৬৫৪)
যীশু খ্রিষ্টের পুনরুত্থান আমাদের জন্য কী বাণী নিয়ে আসে?-
১) অন্তরে পবিত্রতা অর্জন ও তার বহিঃপ্রকাশ
২) পরিবারে পিতা- মাতার সাথে একত্রে বসবাস।
৩) যথার্থ ভাবে জীবন- যাপন করা।
৪) বছরের আদিষ্ট পর্বগুলো তে খ্রিস্টযাগে যোগদান।
৫) পাপের পথ পরিত্যাগ করা।
৬) অন্যকে যথাসাধ্য সাহায্য – সহয়োগিতা করা।
৭)  রিপু রাশি দমন করা।
৮) খ্রিষ্টের সাথে এক হয়ে জনকল্যাণমুখী কাজে অংশগ্রহণ
৯) মণ্ডলির কাজে নিজেকে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত করা।
১০) বিশ্বাসের ভিত মজবুত করা।
১১) অপসংস্কৃতি ত্যাগ ও নিজস্ব সংস্কৃতি লালন
১২) অন্যকে বিচার না করে নিজের দিক টা দেখা।
১৩) পিতা- মাতা ও গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ।
১৪) নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন।
১৫) নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা।
১৬) অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে প্রতিরোধ করা।
১৭) পরিবারের শান্তি আনয়নে কাজ করা
১৮)  মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়ে সমাজের কল্যাণ সাধন।
যিশুখ্রিস্টের পুনরুত্থান আমাদের কাছে এই বাণীই রাখে।পুনরুথান উৎসব নি:সন্দেহে আনন্দের উৎসব। এই উৎসব তখনই আনন্দ উৎসব হবে যখন আমরা একে অপরকে হৃদয়ে স্থান দিতে পারব, আপন করে নিতে পারব, ভালবাসতে পারব এবং ক্ষমা করতে পারব।মৃত্যুন্জয়ী প্রভু যিশু আমাদের সকলকে সেই আশীর্বাদ দান করুন এই কামনা করি।
( তথ্যসহায়িকা: এস কস্তা দিলীপ,খ্রিস্টের পুনরুথান : নব জীবনের প্রত্যাশা।সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, পুনরুত্থান সংখ্যা – ২০২২)
Please follow and like us: