২৫ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ হাসেনবেগপুর পবিত্র ক্রুশ ধর্মপল্লীর জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। কেননা, এই দিন রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল বিশপ রোজারিও এবং পবিত্র ক্রুশ সংঘের প্রভিন্সিয়াল ফাদার জজ্র্ কমলের উপস্থিতিতে এবং নেতৃত্বে ধর্মপল্লীর গিজাঘর ও ফাদার বাড়ি নির্মাণের জন্য মাটি খননের কাজ শুরু হয়। একই দিনে ফাদারদের থাকার জন্য একটি আধা-পাকা ঘরের শুভ উদ্বোধন ও আশির্বাদ করেন পরম শ্রদ্ধেয় বিশপ জের্ভাস রোজারিও। পবিত্র খ্রিস্টযাগে প্রধান পুরোহিত্য করেন বিশপ জের্ভাস রোজারিও এবং সহার্পিত খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করেন পবিত্র ক্রুশ সংঘের প্রভিন্সিয়াল, সহকারি প্রভিন্সিয়াল ও হাসেনবেগপুরের আশে-পাশের ধর্মপল্লীর ফাদারগণ, রিজেন্ট, সিস্টারদ্বয় ও প্রায় ৭০০ জনের মত খ্রিস্টভক্তগণ।

গত ২৫ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের অধিন্যস্ত চাঁদপুকুর ধর্মপল্লীর হাসেনবেগপুর গ্রামে হলিক্রস বা পবিত্র ক্রুশ কোয়াজি ধর্মপল্লী হিসেবে তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। হাসেনবেগপুর গ্রামটি চাঁদপুকুর ধর্মপল্লীর একটি উরাঁও অধ্যুষিত গ্রাম। এই গ্রামকে ধর্মপল্লীতে রূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ফাদার সুবল কুজুর ২১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে চাঁদপুকুর প্যারিশে আসেন এবং ২ বছর চাঁদপুকুর মিশনে থেকে তার পালকীয় কাজ পরিচালনা করেন। ফাদার বেলিসারিও তাকে ২১ ডিসেম্বর ২০২০-এ হাসেনবেগপুর গ্রামে নিয়ে যান। রাজশাহী ক্যাথলিক পবিত্র ক্রুশ সংঘের জন্য হাসেনবেগপুর হলো ২য় কোয়াজি ধর্মপল্লী। তিনি ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩-এ আমি চাঁদপুুকুর প্যারিশ থেকে হাসেনবেগপুরে স্থানান্তরিত হন এবং একটি বাসা ভাড়া করে থাকেন। পরবর্তীতে ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি হাসেনবেগপুর থেকে কৃষ্ণবল্লভ প্যারিশে থাকেন। পরে ২১শে ডিসেম্বর আবার হাসেনবেগপুরে আমার ভাড়া বাসায় ফিরে আসেন। গত ২৫ এপ্রিল, ২০২৪-খ্রিস্টাব্দে বিশপ জের্ভাস রোজারিও আনুষ্ঠানিকভাবে হাসেনবেগপুরকে কোয়াজি ধর্মপল্লী হিসবে ঘোষণা দেন এবং ধর্মপল্লীর নাম দেন পবিত্র ক্রুশ ধর্মপল্লী। বিশপ মহোদয় তার ঘোষণায় আরো বলেন যে, ফাদার সুবল কুজুরই হচ্ছে হাসেনবেগপুর পবিত্র ক্রুশ কোয়াজি ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিশপ মহোদয়, পবিত্র ক্রুশ সংঘের প্রভিন্সিয়াল ফাদার জর্জ কমল, ভাইস প্রভিন্সিয়াল ফাদার সুশান্ত গমেজ, সিএসসি এবং ফাদার উইলিয়াম মুরমুসহ অন্যান্য ও অতিথীদেরকে উরাও ও সান্তালী কৃষ্টিতে বরণ করেন এবং অতিথীদের পা ধোয়ানো ও ফুলের মালা প্রদানের মধ্যদিয়ে বরণ করে নিয়ে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হয়।

পবিত্র খ্রিস্টযাগের শুরুতেই বিশপ মহোদয় বলেন, খ্রিস্টেতে প্রিয়জনেরা, আজকে আমরা অনেক আনন্দিত। আজ হাসেনবেগপুরে একটি নতুন পালকীয় কেন্দ্র বা ধর্মপল্লীর সূচনা হতে যাচ্ছে। এই জায়গা থেকে যে সমস্ত গ্রামে খ্রিস্টবাণী প্রচারিত হবে এবং পালকীয় সেবা দান করা হবে যে সব গ্রাম থেকে বা ধর্মপল্লী সবাই এসেছেন, সবাই আনন্দিত কারণ এখানে ঈশ্বরের বাণী প্রচারের জন্যে কেন্দ্র গড়ে উঠছে। এজন্য আমরা ঈশ্বরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি যদি না করতেন তাহলে আমাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হতো না। আমরা বিশ্বাস করি, সবকিছুই ঈশ্বরের কীর্তি সবকিছুই ঈশ্বরের কাজ এবং আমাদের মধ্যদিয়েই তিনি সে কাজ করে যাচ্ছেন। এই জন্য আমরা ঈশ্বরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই এবং প্রার্থনা করি ঈশ্বরের যে শুভ কাজ আমরা আরম্ভ করেছি: তা যেন তিনি প্রচুর আশির্বাদে ধন্য করে রাখেন এবং আমাদেরকে এই পথে শক্তি সাহস দান করেন। আমরা ধন্যবাদ জানাই পবিত্র ক্রুশ সংঘের যাজক সংঘের ফাদারদের; বিশেষভাবে প্রভিন্সিয়ালের মধ্যদিয়ে পবিত্র ক্রুশ সংঘের যাজকদের ধন্যবাদ জানাই। কারণ, তাদের সহযোগিতায় আমরা যাজকদের পেয়েছি যারা এখানে সেবা দিবেন। পবিত্র ক্রুশ সম্প্রদায় আর্থিকভাবে ও বিভিন্ন ভাবে আমাদেরকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এই জন্য তাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই।

তিনি আরো বলেন, হলিক্রস সম্প্রদায়ের ফাদার সুবল তিনি প্রায় দুই বছরের অধিক সময় ধরে এখানে কাজ করে যাচ্ছেন। আজকে আমরা অস্থায়ী ফাদার বাড়ি আশির্বাদ করতে পারলাম এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এখানে যে গির্জা ও ফাদার বাড়ি নির্মাণ করা হবে সেই প্রজেক্টেরগুলোতে আমরা একসঙ্গে করতে পারব। সেইজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেই এবং আমাদের দাতাবন্ধুদেরও ধন্যবাদ জানাই। আমি ফাদার সুবলকেও অনেক ধন্যবাদ দেই কারণ তিনি অনেক কষ্ট করেছেন এবং দেখা যাচ্ছে যে, বাণী প্রচারের ফল এখানে পাওয়া যাচ্ছে।

পবিত্র ক্রুশ সংঘের প্রভিন্সিয়াল ফাদার জর্জ কমল তার অনুভুতি ব্যক্ত করে বলেন, সত্যিই আজ একটি আনন্দের দিন, একটি সুখের দিন, যে আমরা এই চাঁদপুকুরের একটি কোয়াজি প্যারিশ উদ্বোধন করতে পেরেছি এবং এখানে অস্থায়ী ফাদারদের বাড়ি আশির্বাদ হয়েছে এবং নতুন একটি গির্জা হবে সেটারও গ্রাউন্ড ব্রেকিং এর কাজ শুরু হয়েছে তারপর আবার ফাদারদের জন্য বড় একটি বাড়ি হবে সেটারও গ্রাউন্ড ব্রেকিং হয়েছে। ঈশ্বর সত্যিই আমাদেরকে অনেক কৃপা অনেক আশির্বাদ দান করেছেন। আপনারা প্রার্থনা করবেন আমরা ঈশ্বরের যে রাজ্য স্থাপন করছি একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি তা যেন আমরা চালিয়ে যেতে পারি। ঈশ্বরের নামে যেন আমরা সবাই কাজ করতে পারি এবং মানুষের সেবা করতে পারি। ঈশ্বরের রাজ্য যেন এই পৃথিবীতে স্থাপন করতে পারি। সবাইকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনারা সবাই আমাদের জন্য প্রার্থনা করবেন।

পবিত্র ক্রুশ সংঘের ভাইস প্রভিন্সিয়াল ফাদার সুশান্ত আন্তনি গমেজ তার অনুভূতি ব্যক্ত করেন এভাবে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই কারণ ঈশ্বরের কাজ ঈশ্বর করেন মানুষের মধ্যদিয়ে যেটা বিশপ মহোদয় বলেছেন। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ মহোদয় এই ধর্মপ্রদেশের খ্রিস্টভক্তদের ভালোবেসে সবাইকেই তিনি আহ্বান জানান এবং বলেন, তোমরা আসো, দেখো আমাদের এখানে অনেক প্রয়োজন এ ধর্মপ্রদেশের অনেক মানুষ তাদের আধ্যাত্মিক গঠন, শিক্ষাদান, স্বাস্থসেবা ও মানুষের সার্বিক উন্নয়নের জন্যে কাজ করতে হবে।

চাঁদপুকুর ধর্মপল্লীর কাটেখ্রিস্ট মাস্টার গুপিন তার অনুভূতি তুলে ধরেন এইভাবে, আগে থেকেই ছক করা ছিল হাসানবেগপুরে মিশন হতে পারে। ঈশ্বর আমাদের চাঁদপুকুরবাসীর কথা মনে হয় বুঝতে পেরেছেন আর ঠিকই এই জায়গাটা বেছে নিলেন। আপনাদের জন্য অনেক আনন্দের কথা সেটা হলো আপনারা ফাদারকে পেয়েছেন। আমাদের প্রয়াত: ফাদার এ্যামেলিও স্পিনেল্লী বলতেন, যেখানে ফাদার থাকবেনা সেখানে কাথলিক মণ্ডলি গড়ে উঠবেনা। আপনারা ফাদারকে সহযোগিতা করবেন। তার অনেক মনোবল বাণী প্রচারের জন্য। এক সময় তিনি আমার সামনে বলতেছিলেন, আমি হাসেনবেগপুরে থাকব আর একদিক থেকে দীক্ষা দিয়ে যাব। অনেক খ্রিস্টান হবে কিন্তু আপনারা যদি সাহায্য না করেন তাহলে তো খ্রিস্টান হবে না। চাঁদপুকুরে খ্রিস্টবাণী প্রচার হলো ভালো কাজের মধ্যদিয়ে।

কাটাডাঙ্গার পাল-পুরোহিত ফাদার রঞ্জিত, ওএমআই বলেন, আজকে এই আনন্দ দিনে এইখানে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করছি। ফ্রান্সিস বেকম বলেছেন, যখন নাকি আমরা আনন্দ সহভাগিতা করি সেটা দ্বিগুণ হয় আর যখন দুঃখ সহভাগিতা করি সেটা অর্ধেক হয়। তাহলে আজকে আমরা সবাই আনন্দিত এই সুন্দর দিনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই তিনি এই ডায়োসিসের মধ্যদিয়ে বিশপ মহোদয়ের মধ্যদিয়ে হলিক্রস ফাদারদের মধ্যদিয়ে এই ধর্মপল্লীকে আশির্বাদিত করেছেন এবং আপনাদের সবাইকে আশির্বাদিত করেছেন।

পত্নীতলা থানার অফিসার ইনচার্জ মোজাফ্ফর বলেন, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ ধর্ম হচ্ছে খ্রিস্টান ধর্ম। প্রায় ২৫০ কোটি মানুষ এই ধর্ম পালন করছে। আপনাদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ হচ্ছে বাইবেল আর আমাদের ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে কোরান। কোরান এবং বাইবেলের মধ্যে একটা মিল রয়েছে এবং আমাদের ধর্মের সাথে আপনাদের খ্রিস্টান ধর্মের বড় একটা মিল রয়েছে। আপনাদের ধর্মের মর্মবাণী হচ্ছে শান্তি আমাদেরও ইসলামের মূলবাণী হচ্ছে শান্তি।

ফাদার সুবল কুজুর, সিএসসি তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, আজ আমি সত্যিই খুব খুশি এবং আনন্দিত এই জন্য যে, হাসেনবেগপুর গ্রামে বসবাস করার একটি আধা পাকা বাড়ি পেয়েছি এবং আজই বিশপ মহোদয় হাসেনবেগপুরকে কোয়াজি ধর্মপল্লী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন এবং গির্জা ও ফাদার বাড়ি নির্মাণের লক্ষ্যে মাটি খনন করেছেন। আমি আজকের এই দিনটির জন্য বিগত বছরগুলোতে আন্তরিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি এবং সেই সাথে সাথে ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করেছি যেন তিনি তার এই সেবকের মধ্যদিয়ে হাসেনবেগপুরকে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মপল্লীতে উন্নীত করতে সাহায্য করেন। আসলে, কোন বাড়ি ঘর কোন মিশন নয় জনগণই হলো মিশন। তাই, আজকের এই দিনে শত শত ভক্তদের আগমনে আমার এ মিশনে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। তাই আমি সকলের কাছে প্রার্থনা চাই ঈশ্বর যেই কাজ শুরু করেছেন সেই কাজে আত্ম নিয়োগ করে আমি যেন তার ইচ্ছাই পূর্ণ করতে পারি। পরিশেষে, বিশপ মহোদয়, প্রভিন্সিয়ালসহ আপনাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই আজকের এই অনুষ্ঠানকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলার জন্য।

বরেন্দ্রদূত নিজস্ব রিপোর্টার

Please follow and like us: