ফাদার সুনীল রোজারিও। বরেন্দ্রদূত প্রতিনিধি

ভাটিকান : পোপ ফ্রান্সিস, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এশিয়া ও ওশেনিয়া সফর করবেন। ভাটিকান সিটি থেকে পোপের গণমাধ্যম দপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে যে, পোপ সেপ্টেম্বর মাসের ২ থেকে ১৩ তারিখ পযর্ন্ত ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি, পূর্ব তিমুর এবং সিঙ্গাপুর সফর করবেন। সংবাদ মাধ্যমের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে, পোপের সফরের তালিকাভুক্ত দেশগুলোর সরকার এবং স্থানীয় মণ্ডলির আমন্ত্রণে পোপ এই সফরে যাচ্ছেন।

পোপ ফ্রান্সিস ৩ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা গিয়ে পৌঁছাবেন। ২০২০ খ্রিস্টাব্দে পোপের জাকার্ত সফরের কর্মসূচি থাকলেও করোনা ভাইরাসের কারণে তখনকার মতো সফর বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিলো। পোপের এই ইন্দোনেশিয়া সফর শুধু খ্রিস্টানদের জন্য নয় বরং সব সম্প্রদায়ের জন্য সহনশীলতা, একাত্মতা ও শান্তির বার্তা বহন করছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই মুসলিম দেশের মোট মুসলিম জনসংখ্যা ২৪২ মিলিয়ন, ২৯ মিলিয়ন খ্রিস্টান এবং যার মধ্যে ৮.৫ মিলিয়ন বা ৮৫ লক্ষ ক্যাথলিক। পোপ ৬ষ্ঠ পৌল ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়া সফর করেছিলেন। এরপর পোপ ২য় জন পল ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিযা সফরের পর পোপ ফ্রান্সিস হবেন ৩য় পোপ যিনি ইন্দোনেশিয়া সফরে যাচ্ছেন।

পোপ ২য় জন পল ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে পাপুয়া নিউ গিনি সফরের পরে পোপ ফ্রান্সিসই হবেন প্রথম পোপ যিনি পাপুয়া নিউ গিনি সফরে যাচ্ছেন। জাকার্তা থেকে পোপ ৬ সেপ্টেম্বর পাপুয়া নিউ গিনি গিয়ে পৌঁছাবেন। পাপুয়া নিউ গিনির মোট জনসংখ্যা এক কোটি পাঁচ লক্ষ যার মধ্যে ৩২ শতাংশ ক্যাথলিক। পোপ তাঁর এই সফরে রাজধানী মোরেসবাই এবং ভানিমো শহর সফর করবেন। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে পোপ ২য় জন পল পাপুয়া নিউ গিনি সফরের পর এটাই হবে কোনো পোপের সেদেশে প্রথম সফর।

পূর্ব তিমুরের মোট লোকসংখ্যা ১২ লক্ষ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে ফিলিপাইন ছাড়া একমাত্র খ্রিস্টান দেশ। পূর্ব তিমুরের ৯৭.৬% লোক ক্যাথলিক। পোপ সেপ্টেমর ৯ থেকে ১১ তারিখ পযর্ন্ত পূর্ব তিমুর সফর করবেন। পূর্ব তিমুর ২০০২ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পর কোনো পোপের এটাই প্রথম সফর।

সবশেষে পোপ সেপ্টেম্বর ১১ থেকে ১৩ তারিখ পযর্ন্ত সিঙ্গাপুর সফর করবেন। এর আগে পোপ ২য় জন পল ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে সিঙ্গাপুর সফর করেছিলেন। সিঙ্গাপুরের কার্ডিনাল উইলিয়াম গো- যাকে পোপ ফ্রান্সিস ২০২২ খ্রিস্টাব্দে সিঙ্গাপুরের প্রথম কার্ডিনাল হিসেবে মনোনীত করেছেন। সিঙ্গাপুরের মোট লোকসংখ্যা ৬০ লক্ষ যার মধ্যে তিন লক্ষ ৯৫ হাজার ক্যাথলিক।

৮৭ বছর বয়স্ক পোপ ফ্রান্সিস ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ দায়িত্ব গ্রহণের পর এটা হবে তাঁর ৪৫তম বিদেশ সফর। পোপ ইতিমধ্যে বিশ্বের ৬১টি দেশ সফর করেছেন।

ইরাক : ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে ক্যালডিয়ান প্যাট্রিয়ার্ক, কার্ডিনাল লুইস রাফায়েল সাকো ইস্রায়েল ও ইরানকে শান্ত থাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন- ইস্রায়েল এবং ইরান যদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে ইরাকের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কার্ডিনাল সাকো ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ইরাক-ইরান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে এর ভয়াবহতা তুলে ধরেন। যাজক হিসেবে গত ৫০ বছরে তিনি যুদ্ধের কারণে বহু নিরীহ মানুষের জীবন বিপন্ন হতে দেখেছেন। কার্ডিনাল সাকো- আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনুরোধ জানিয়েছেন তারা যেনো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য জোরালো ভুমিকা পালন করেন। দামেস্কে অবস্থিত ইরানের দূতাবাসে ইস্রায়েলের বিমান হামলার প্রতিবাদে ইরানও ইস্রায়েলে হামলা চালায়। এই হামলার পাল্টা জবাব হিসেবে ইস্রায়েল গত ১৯ তারিখ শুক্রবার ভোরে ইরানের ইসফাহান শহরে বিমান হামলা চালায়। এতে করে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের আরোও অবনতি ঘটে।

ভিয়েতনাম : ভাটিকানের বিদেশ বিষয়ক সচিব আর্চবিশপ পৌল রিচার্ড গাল্লাহের- ভিয়েতনামের ক্যাথলিক চার্চকে একটি জীবন্ত শৈল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গাল্লাহের গত ৯ তারিখ ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় গিয়ে পৌঁছেন। তিনি হ্যানয়ের সেন্ট যোসেফ ক্যাথিড্রালে খ্রিস্টযাগ অর্পণকালে জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, “ভিয়েতনামের ক্যাথলিক চার্চ দেশের মধ্যে যে সাক্ষ্য বহন করে চলেছে তা সত্যিই হৃদয়কে স্পর্শ করে।” ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েতনামের সঙ্গে ভাটিকানের কূটনৈতিক সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর ভাটিকানের উচ্চ পর্যায়ের কোনো প্রতিনিধির এটাই প্রথম ভিয়েতনাম সফর। দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য পোপ ফ্রান্সিস হ্যানয় সফর করবেন বলে ভাটিকান থেকে বলা হয়েছে। আর্চবিশপ গাল্লাহের ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী ফাম মিন চিন-এর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। ভিয়েতনামে ক্যাথলিকের সংখ্যা ৭০ লক্ষ।

বাংলাদেশ : গত ১৯ এপ্রিল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বনানীতে অবস্থিত পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারি প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ জয়ন্তী ধর্মীয় পরিবেশ ও আনন্দ-গানে পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে ভাটিকানের রাষ্ট্রদূত আর্চবিশপ কেভিন রাণ্ডাল। সকাল ৮:৩০ মিনিটে কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও কর্তৃক জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সকল ডায়োসিসের বিশপগণ। জাতীয় সঙ্গীতের পর পরই জুবিলী উপলক্ষে নির্মিত ‘স্মারক স্মৃতির’ মোড়ক উন্মোচন ও আশির্বাদ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ঢাকার আর্চবিশপ ও বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনীর প্রেসিডেন্ট বিজয় এন ডি’ক্রুজ, ওএমআই।

সকাল ৯টায় জুবিলী মূল অনুষ্ঠান পবিত্র খ্রিস্টযাগ দিয়ে শুরু হয় কার্ডিনালের পৌরহিত্যে। তার সঙ্গে ছিলেন ভাটিকানের রাষ্ট্রদূত আর্চবিশপ কেভিন রাণ্ডাল; আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজ, ওএমআই; আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি; বিশপ জের্ভাস রোজারিও, বিশপ জেমস রমেন বৈরাগি, বিশপ পল পনেন কুবি, বিশপ সেবাস্টিয়ান টুডু, বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ, বিশপ ইম্মানুয়েল রোজারিও ও বিশপ মনোনীত ফাদার সুব্রত বনিফাস গমেজ। এছাড়াও দুই শতাধিক যাজক, বেশ কিছু সংখ্যক ব্রাদার, সিস্টার ও খ্রিস্টভক্তসহ মোট ৮৪০ জন উপস্থিত ছিলেন।

খ্রিস্টযাগের উপদেশে মহামান্য কার্ডিনাল পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারি প্রতিষ্ঠা ঈশ্বরের একটি মহাদান ও অনুগ্রহ বলে উল্লেখ করেন এবং একে বাংলাদেশ খ্রিস্টমণ্ডলির হৃদয় হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। এই প্রতিষ্ঠানটির মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ মণ্ডলি স্থানীয় হয়ে ওঠার যাত্রায় রয়েছে। এ সেমিনারি থেকে শিক্ষা নিয়ে মণ্ডলি পরিচালনায় সেবাময় নেতৃত্ব দিচ্ছে যাজকগণ, সন্ন্যাসব্রতী ও সন্ন্যাসব্রতিনীগণ।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অংশে ছিল স্মৃতিচারণ। বিশপীয় সেমিনারি কমিশনের প্রেসিডেন্ট বিশপ ইম্মানুয়েল রোজারিও’র স্বাগত বক্তব্যের পর জুবিলী উৎসবের মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন রাজশাহীর বিশপ জের্ভাস রোজারিও। তিনি পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারি প্রতিষ্ঠার পটভূমি তুলে ধরে এ সেমিনারিতে অধ্যাপনা ও অধ্যয়নরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একসাথে পথ চলা, গবেষণা ও ঐশতাত্ত্বিক লেখনীর উপর জোর দেন। মূল বক্তব্য উপস্থাপনের পর ফাদার বুলবুল আগষ্টিন রিবেরু’র গ্রন্থণায় ও পরিচালনায় প্রামাণ্য দলিল ‘গৌরবে সৌরভে পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারি’ প্রদর্শিত হয়। এরপর ফাদার কোমল খাঁ সম্পাদিত জুবিলীর বিশেষ স্মরণিকা ‘প্রজ্ঞাপ্রবাহ’ এর মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধান অতিথি আর্চবিশপ রাণ্ডাল। অতঃপর সেমিনারির ছাত্র ও অধ্যাপক ফাদার প্রশান্ত থিওটোনিয়াস রিবেরু, আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ ক্রুজ, সিবিসিবি’র সেক্রেটারি জেনারেল- ময়মনসিংহের বিশপ পল পনেন কুবি, সিএসসি, স্মৃতিচারণ ও বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ভাটিকানের রাষ্ট্রদূত আর্চবিশপ কেভিন রাণ্ডাল সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সেমিনারির পরিচালকমণ্ডলী, শিক্ষকমণ্ডলী ও শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে এ মহতী অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে তার আনন্দ প্রকাশ করেন।

বেলা ৩টায় শুরু হয় জুবিলীর আনন্দের অন্যতম আকর্ষণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে বিভিন্নস্থানের শিল্পী ও সেমিনারিয়ানগণ অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী অনিমা মুক্তি গোমেজও এই বিশেষ দিনে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনসহ গান পরিবেশন করেন।

২৩ আগস্ট ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে পুণ্যপিতা পোপের প্রতিনিধি মহামান্য আর্চবিশপ এডুয়ার্ড ক্যাসিডি রমনা ক্যাথিড্রাল গির্জায় সহার্পিত খ্রিস্টযাগের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয় উচ্চ সেমিনারি’ উদ্বোধন করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ‘জাতীয় উচ্চ সেমিনারি’ ৬ জন অধ্যাপক ও ৫ জন সেমিনারিয়ান নিয়ে ম্যাথিস হাউজে যাত্রা শুরু করে। ৫০ বছরের এই যাত্রায় মোট ৯৮৭জন শিক্ষার্থী পবিত্র আত্মা সেমিনারিতে পড়াশুনা করেছেন। এদের মধ্যে ৯জন বিশপসহ যাজক হয়েছেন ৪৪৫জন। এছাড়াও ৮৩জন ব্রাদার ও ১১জন সিস্টার সেমিনারির শিক্ষায় আলোকিত হয়েছেন। এ কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন ও আছেন মোট ১০৩জনের অধ্যাপকমণ্ডলী। এ সেমিনারি থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের ৮টি ধর্মপ্রদেশে, কেউ কেউ দেশের বাইরেও বিবিধ পালকীয়, কাজ করছেন। পবিত্র আত্মা সেমিনারির এই দীর্ঘ যাত্রাকে আমরা অভিনন্দন জানাই।

Please follow and like us: